মিরাজুন্নবী (সা.) এবং আত্মিক পরিশুদ্ধতার ১৪ দফা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মিরাজের পরিচয় মিরাজ মূলত: দুই ভাগে বিভক্ত, প্রথমাংশ হলো ইসরা এবং দ্বিতীয়াংশ হলো মিরাজ। অসিরা শব্দটি আরবী। এর উৎপত্তি হলো ইসরা থেকে অভিধানিক অর্থ হলো রাতে নিয়ে যাওয়া, রাতে ভ্রমণ করা বা রাতে চলা ইত্যাদি পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত (সফর) ভ্রমণকে ইসরা বলে।

দ্বিতীয়াংশ মিরাজ : মিরাজ শব্দটি আরবী উরজুন থেকে এসেছে যার দ্বারা আরোহন বুঝায়। অভিধানে অর্থ হলো, সিঁড়ি সোপান, ধাপ বা উর্ধ্বগম ইত্যাদি। পরিভাষায় মসজিদে আকশা থেকে সাত-আকাশ, সিদরাতুল মুনাতাহা ইত্যাদি ভ্রমণকে মিরাজ বলে। শরই অর্থ মসজিদে আকশা থেকে সাত আকাশসহ সিদরাতুল মুনতাহা পাড়ি দিয়ে আরশ মুয়াল্লাহ আল্লাহর দরবারে রাসুল (সা.)-এর ভ্রমণকে মিরাজ বলে।

মিরাজ কেন প্রয়োজন : মহান আল্লাহ পাক তার নবী-রাসুলগণকে নবুওয়াতের গুরু-দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশে তার রহমতের সর্বাধিক কাছে ডেকে নিতেন এবং ওই ডাকে হাজির হওয়াকে মিরাজ বলা হয়। মিরাজ প্রত্যেক নবী-রাসুলগণের হয়েছিল। কিন্তু সবার মিরাজ একই স্থান বা এক ধরনের হয়নি। যেমন- হজরত আদম (আ.)-এর মিরাজ হয়েছিল জন্নাতে, হজরত মুসা (আ.)-এর মিরাজ হয়েছে তুর পাহাড়ে, ইব্রাহিম (আ.)-এর মিরাজ হয়েছে মরুভূমির মধ্যে আর আমাদের নবী (সা.)-এর মিরাজ একবারে সাত আসমানের উপর আরশ আজিমে। আমাদের নবী (সা.) যেহেতু শেষ নবীও বিশ্ব নবী ছিলেন তাই তার দায়িত্ব ও ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তার ট্রেনিংও ছিল সর্বাধিক দায়ী। তাই তা ছিল বিরাট লম্বা কোর্সেরও দীর্ঘ সময়ের আর তার স্থান ছিল খোদ রাব্বুল আলামীনের রাজধানীতে। মিরাজ এর আরো কয়েকটি মৌলিক কারণ ছিল। মহানবী (সা.) জন্মের আগেই পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। জন্মের ৬ বছর পরে মাতা আমেনা ইন্তেকালের পর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে লালিত-পালিত হন। মহানবী (সা.)-এর বয়স যখন ৮ বছর, তখন দাদাও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হন। যুবক হলে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে খাদিজার বিয়ে হয় এবং শুরু হয় পারিবারিক জীবন। ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন। ৩ বছর গোপন দাওয়াত এরপর প্রকাশ্যে ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়াতে কাফের মুশরিকদের মাথাব্যথা বেড়ে যায়। নবুওয়াতের ১১তম বছর রাসুল (সা.)-এর ৫১ বছর বয়সে ইসলামের দুশমনরা নবী করিম (সা.) এবং তার সাহাবীদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়নের স্টিমরোলার চালায়। এই কঠিন সময়ে রাসুল (সা.)-এর ঢাল ছিলেন চাচা আবু তালিব। তিনি নিজ ক্ষমতার প্রভাবে কাফিরদের অত্যাচার-নির্যাতন হতে মহানবী (সা.) কে রক্ষা করতেন। ঘরের ভেতর হজরত খাদিজা (রা.) মহানবীকে সান্তনা এবং কৌশলে পরামর্শ দিয়ে দুঃখ দূর করার জন্য চেষ্টা করতেন। মহান আল্লাহর কি ইচ্ছা এ বছর সামান্য ব্যবধানে আবু তালিব ও খদিজা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। এদের মৃত্যুতে রাসুল (সা.) হতাশ হয়ে ভেঙে পড়েন। ভাঙ্গা হৃদয়ের বেদনাগুলো দূর করার জন্য তখন আল্লাহ মহানবীকে তার একান্ত সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন। রাসুল (সা.)-এর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছর ৫৩ বছর বয়সে মদিনায় হিজরত করে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ কল্যাণময় সমাজ গঠন করবেন। সেই সমাজ ব্যবস্থার মূলনীতি কি হবে এবং এলাকাটি কোথায় হবে তা স্বচক্ষে দেখবার জন্য মিরাজ এ নিয়ে যান এবং আল্লাহতালার কিছু নিদর্শন বিশেষ করে জান্নাতবাসীদের পুরস্কার ও জাহান্নামে জাহান্নামীদের শাস্তির করুণ চিত্রগুলো স্বচক্ষে দেখানোই মিরাজের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়াও হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলদের সঙ্গে পরিচয় মোলাকাত, ঐতিহাসিক স্থানগুলো এবং আরো কতিপয় আল্লাহর কুদরতী নিদর্শন তাকে দেখানো হয়।

শান্তি প্রতিষ্ঠার ১৪ দফা : ১। আল্লাহর আইনের আনুগত্য করা। মানব রচিত মতবাদ দিয়ে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদুর পরাহত। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ২। পারিবারিক জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলার জন্য পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণ করা। ৩। সামাজিক বন্ধন মজবুত করার জন্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভালো আচরণ করা, তাদের হক এবং মিসকিন ও পথিক (মুসাফির) দের হক আদায় করা। ৪। অপচয় না করা। আল্লাহ বলেন, তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় খরচ এবং আত্মীয়-স্বজনের ফকির-মিসকীনের হক আদায় না করে বিভিন্ন খাতে প্রচুর টাকা অপচয় করি। ৫। আয়-ব্যয় ভারসাম্য রাখতে হবে। ভারসাম্যহীন জীবন মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে তাই আয় এবং ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে খরচ করতে হবে। বেহিসাবী খরচ যেমন করা যাবে না তেমনি আবার কৃপণ ও হওয়া যাবে না। ৬। রিযিক বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহর যে নীতি কাউকে বেশি আবার কাউকে কম দিয়েছেন। তা মেনে নেওয়া। এ নীতি অত্যন্ত যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং এ নীতি ধনী-গরিব সবার জন্য কল্যাণকর। ৭। নিজ সন্তান হত্যা না করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা গরিব হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদের ও তোমাদের রিজিক আমি দেব’। খাওয়া-পরার ভয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করা বড় ধরনের অপরাধ। আমাদের উচিত সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়ে তাদের সুশিক্ষিত করে সম্পদে পরিণত করা। ৮। জ্বেনা ব্যভিচার ও অশ্লীলতা রোধ করা। জেনা ব্যভিচার ও অশ্লীলতা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জন্য এক ভয়ংকর মহামারী। অশ্লীলতার কারণে নৈতিক ও চরিত্রহীন যে সমাজ গঠিত হয় তা জাতির জন্য অভিশাপ। ৯। বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন- ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তোমরা এই আদেশ মেনে চলবে যে কাউকে হত্যা করবে না’। কারণ মানুষের জীবন আল্লাহর কাছে অতি পবিত্র। তাই মানুষ হত্যা তিনি হারাম করেছেন। এ আদেশের মধ্যে গুপ্ত হত্যা, বিনা বিচারে হত্যাসহ সব প্রকার খুন, গুম ও অপহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১০। ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণ করা। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কখন এতিমের মাল স্পর্শ করো না’। কিন্তু এতিম যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞন বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ার মতো বয়সে না পৌঁছে, ততদিন পর্যন্ত তার সম্পত্তি দেখাশোনা করা উত্তম। ১১। ওয়াদা, চুক্তি ও অঙ্গীকার পালন করা, ওয়াদা বা চুক্তি বা ব্যক্তিগত হোক বা রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়ের হোক যে কোনো চুক্তি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২। ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা। বর্তমান অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফভিত্তিক বিলি বণ্টন না থাকার কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। একদল লুটেরা ও আরেক দল বিরত থেকেই যাচ্ছে। ১৩। অনুমানভিত্তিক কোনো কাজ করবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত মনগড়া অনুমাননির্ভর না হয়ে শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও চিন্তা শক্তিসহ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বিপদগামী বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ১৪। অহংকার পরিহার করা। আল্লাহ বলেন- তোমরা জমিনের উপর দিয়ে কখনো গর্ব করে চলাফেরা করো না। তোমাদের গর্ব, অহংকার জমিন ভাঙতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান ও উঁচু হতে পারবে না। অহংকার আল্লাহর চাদর এটি শুধু তাঁর জন্য। আল্লাহর বান্দার জন্য অহংকার শোভা পায় না। অতীতে অনেক জাতি, বড় স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী, গর্ব অহংকার করে ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের উচিত গর্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করা। আধুনিক পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র যদি এসব ধারাগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর করা হয়, তাহলে আর কি এমন কোনো চোরাপথ খোলা থাকে, যে পথ ধরে সমাজে অশান্তি ঢুকতে পারে?

লেখক : গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান