ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঐশী প্রেমের দূত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা

ইকবাল মাসুদ
ঐশী প্রেমের দূত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার শত পরিচয়ের মধ্যে আরো একটি পরিচয় ঐশী প্রেমের দূত হিসেব। অর্থাৎ, যে সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা সব সৃষ্টিজগত ও জীবসত্তার ধমনীতে স্পন্দিত, কোরআনের বাণী মোতাবেক যে প্রেমের কারণে এই সৃষ্টিজগতের উৎপত্তি এবং হাদিসে কুদসির মর্ম অনুযায়ীও জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য আল্লাহকে জানা, আর মাধ্যম হলো প্রেম। এই আদর্শকে ধারণ করেই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নিজেকে স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করেছেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা শরিয়তের সিঁড়ি বেয়ে তরিকতের মধ্যদিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন তাঁর কর্ম ও জীবনের প্রতিটি স্তরে।

শুধু ধর্ম পালন নয়, ধর্ম ছিল তাঁর কাছে সাধনা এবং তাঁর জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও কর্মের সঙ্গে যুক্ত করে ইসলামের আদর্শকে নতুন রূপে চেনার পথ উন্মোচন করা। সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর প্রেম ও ভক্তির মধ্যদিয়ে জীবনকে গড়েছেন ও অধ্যাত্ম জগৎকেই সমৃদ্ধ করেছেন। অন্তর আত্মাকে প্রসারিত করে সৃষ্টিকর্তার অসীমতাকে অবিনশ্বর সত্যের প্রকাশরূপে অনুধাবন করেছেন। জীবাত্মা থেকে পরমাত্মার পথে যাত্রায় নিজেকে বিলীন করে দেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি মনে করতেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম না থাকলে সৃষ্টিকর্তাকে নিজের ভিতর অনুভব করা যায় না। শরিয়তের বিধান পালনের মধ্যদিয়ে একজন সুফি তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সৃষ্টিকর্তার অনুগত করেন। শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ সুফি হতে বা ঐশী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারে না। এজন্য খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা শরিয়ত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘তরীকতের মূলে মহব্বত, আবার মহব্বত খাঁটি হয় না, যে পর্যন্ত নফছ বশীভূত না হয়, খোদী না মেটে, সম্পদে বিপদে ধৈর্য না জন্মে। খোদার উপর পূর্ণ নির্ভরতা না আসে। জ্ঞানের দ্বারা খোদাকে পাওয়া যায় না। প্রেম দ্বারা পাওয়া যায়।’ সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ নির্ভরতা ও ঐশী প্রেমেই সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার মূলকথা। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা-এঁর আধ্যাত্মিকতার সবকিছু আবর্তিত হয়েছে ঐশী প্রেমকে কেন্দ্র করে, সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়াকে জন্য। আধ্যাত্মিকতার ওয়াহদানিয়াত স্তরে উত্তীর্ণ ছালেক বা আরেফ সব কিছু বিলীন করে দিয়ে, নিজেকে ভুলে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার সত্তায় স্থিতি লাভ করে থাকেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর জীবনে সংসারের মধ্যে থেকেও সংসার ত্যাগী হয়ে সব কিছু বিলীন করেছেন সৃষ্টিকর্তার জন্য। তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থগুলোয় অত্যন্ত মনোগ্রাহী বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে এক অখণ্ড অধ্যাত্মিক ভাব-বলয় তৈরি করেছেন। সৃষ্টিকর্তার অনন্ত শক্তি, অনন্ত ঐশ্বর্য, অনন্ত লীলা অনুধাবন করতে গেলে তা শুধুমাত্র ব্যক্তির জ্ঞানের পরিধির মধ্য থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এর জন্য সাধনা ও ত্যাগের প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তা প্রেমের স্বরূপ, তাঁকে ভালো না বাসলে তাঁকে বোঝাও দুষ্কর। সৃষ্টিকর্তা ও রাসুলের দর্শন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নিজে পালন করে দেখিয়েছেন। প্রতিটি মুহূর্তে তিনি সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে উপলব্ধি করেছেন এবং ঐশী প্রেমের মধ্যদিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে ‘প্রেমিকের মৃত্যু নেই। সে ইহজীবনে প্রভুর মিলন উপভোগ করে। প্রেমিকের মৃত্যু স্বর্গ ও মর্ত্ত্যরে সিঁড়িস্বরূপ। সে দেহ ত্যাগ করিয়া পর জীবনের প্রাসাদ ভোগ করিতে থাকে। মনে রাখিতে হইবে যে, পর-জীবন ইহ-জীবনেরই বিস্তৃতি। ইহলোকে যিনি যেরূপ বীজ বপন করিবেন, পর-জীবনে তিনি সেইরূপ ফসলের অধিকারী হইবেন।’ তিনি মনে করতেন, ঐশী প্রেমের মধ্যে অহমিকা, রিয়া, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদির কোনো স্থান নেই। যখন কারো মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম সৃষ্টি হয়, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য যার অন্তরে প্রেম, মহব্বত বা ইশ্ক সৃষ্টি হয়, তখুনি তিনি বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারেন ঐশী প্রেমের মহিমা। স্রষ্টার প্রতি প্রেম অসীম, মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইহজাগতিক জীবনে সমাপ্তি ঘটলেও পবিত্র আত্মা তাঁর মাহবুবের সঙ্গে মিলনের জন্য একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে গমন করে। মাহবুবের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের পরিসমাপ্তি কখনো ঘটে না। এ প্রেমের শুরু আছে, শেষ নেই। আর এসব অনুভব খানবাহদুর আহ্ছানউল্লা’র লেখনিতে বর্ণিত হয়েছে এবং তিনি জীবনকাল ব্যাপী এই পথে ধাবিত হয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা যত জীব সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে তিনি মানুষকেই সবদিক থেকে উৎকৃষ্ট করেছেন। বিবেক-বুদ্ধিতে দয়া-মায়া প্রেমে, সব অর্থেই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা তার সব গুণাবলি দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। খানবাহদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর জীবনে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গুণাবলি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে ও তার চর্চা করেছে। এ জন্য মানুষ হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজে যেমন আত্মা উন্নতির মধ্যদিয়ে চিরন্তন প্রেমের আকর্ষণে অক্লান্ত পথিকের মতো আজীবন ছুটে ছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর অনুসারী ও ভক্তকুলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। নিজেকে ছোট জ্ঞান করা, অমিত্ব বর্জন করা, অন্যের দোষ তালাশ না করে, নিজের দোষ তালাশ করা, সৃষ্টার সৃষ্টির প্রতি দয়া করা, ক্ষুধার্ত মানুষকে আহার দেয়া, দরিদ্র বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া, অসুস্থকে সেবা করা, শরিয়তের সব আদেশ নিষেধ পালনের মধ্যদিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করাই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) আধ্যাত্মিকতার মূল শিক্ষা। ঐশী প্রেম খোদায়ী বিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ঐশী প্রেমের অভিজ্ঞতা সকল সুফি সাধকরা সঞ্চয় করেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন এবং এই ঐশী প্রেমের মাধ্যমেই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন এবং সবার মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকাল ঐশী প্রেমের কথা খুব কমই শোনা যায়। তাই আমি মনে করি বর্তমান প্রজন্মের কাছে যদি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার নিজস্ব বাণী ও দর্শন নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়, তাহলে ঐশী প্রেমের বিস্তারের মধ্যদিয়ে মানবতার জয় হবে। এছাড়া খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার ঐশী প্রেমের বাণী চর্চা করতে পারলে আমাদের দৃষ্টি সুপ্রসারিত হবে। কেন না, আলোকিত মানব যা দেখতে পান এবং উপলব্ধি করেন, তা অধিকাংশ মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। আধ্যাত্মিকতার আলোয় উদ্ভাসিতজন তাদের প্রাপ্ত আলোকচ্ছটার অংশ অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রায় অদৃশ্য জ্ঞান পেয়ে থাকেন। সর্বোপরি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তাঁর সোহবতের ধাপগুলোকে একই সূত্রে গেঁথেছেন, যাতে পরিস্ফুট হয়েছে খোদায়ী আজ্ঞা পালনে সদিচ্ছা, তিনি সারা জীবন নিজেকে উৎসর্গ করেই অন্তরে ঐশী প্রেমের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন।

লেখক : পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং সদস্য, নির্বাহী কমিটি, নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত