ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাই চক্র

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই
রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাই চক্র

একান্ত প্রয়োজনে গভীর রাত কিংবা ভোরের দিকেও মানুষকে রাস্তায় বের হতে হয়। রাজধানীতে রাতের সময়টি রাস্তায় থাকা দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কেন না, রাতে ছিনতাইকারী চক্র তৎপর হয়ে উঠে। তারা ধারাল অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দামি মোবাইল ফোনসেটসহ অর্থকড়ি কেড়ে নিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে মানুষ বাস্তবিক অর্থে মোবাইল ফোন ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না। একটি মোবাইল ফোনের মধ্যে প্রচুর তথ্য রেকর্ড থাকে। মোবাইলটি ছিনতাই হয়ে গেলে মানুষ সেসব তথ্য হারিয়ে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে। রাত যত গভীর হয়, রাজধানীর সড়কে ততই কমতে থাকে যানবাহনের সংখ্যা। আর এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা। তারা মোটরবাইক ও প্রাইভেট কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় শহরের বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলি। তাদের প্রধান শিকার হয় রিকশাযাত্রী বা পথচারী। তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনিয়ে নেয় টাকা ও মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী। আবার কখনো ছোঁ মেরে নিয়ে যায় হাতের ব্যাগ। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে চলে যায় ছিনতাইকারী চক্র। রাতভর ছিনতাই ঠেকাতে ডিএমপির পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। মাসে মাসে এই টাস্কফোর্স বৈঠকে বসে। ছিনতাই দমনে নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। তারপরও ছিনতাই কমছে না। এমনিতেই রাতের ঢাকায় পুলিশি টহলের ঘাটতি থাকে। কোথাও কোথাও পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সন্দেহভাজনদের তল্লাশিও করা হয় না। ছিনতাইকারীরা পুলিশের টহল এড়িয়ে অন্য এলাকায় ছিনতাই করে বেড়ায়। মোটরসাইকেলযোগে আসা ছিনতাইকারীরা যানবাহন গতিরোধ করে। দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মূল্যবান সামগ্রী লুটে নেয়। থানায় অভিযোগ করা হলেও ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা কম। তবে ডিএমপির কর্মকর্তাদের দাবি ছিনতাই প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করার পাশাপাশি বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করা হলেও আদালতের মাধ্যমে তারা জামিনে বের হয়ে এসে আবার আগের মতো ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে।

সে কারণে এত বেশি মানুষের আবাসস্থল ঢাকায় ছিনতাই পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত রাত ১০টার পর থেকেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেপারোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারী চক্র। মোটরসাইকেলে করে ছিনতাইকারীরা ধারালো বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ঘুরতে থাকে। যেসব সড়কে যানবাহন কম থাকে এবং পর্যাপ্ত আলো থাকে না, সেসব এলাকার রিকশাযাত্রী বা পথচারীদের টার্গেট করে তারা। চক্রটি এক জায়গায় ছিনতাই শেষে অন্য সড়কে চলে যায়। একই কৌশল অবলম্বন করে প্রাইভেট কারযোগে ছিনতাই করা চক্রটিও। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকাতেই পুলিশের টহল ও চেকপোস্টে থাকলেও পুলিশের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা যায়। ছিনতাইকারীরা পুলিশের টহল গাড়ি বা চেকপোস্ট এড়িয়ে চলে। সে কারণে বেশি বেশি করে টহল গাড়ি বা চেকপোস্টের ব্যবস্থা করলে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা হযতো কমে যেত। রাজধানীর সড়কে অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইকারীরা এর সুযোগ নিচ্ছে। টহল পুলিশ বা চেকপোস্টে তাদের তল্লাশি করলে তারা উবার-পাঠাওয়ের যাত্রী পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। এটা শুনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তল্লাশি না করেই তাদের যানবাহন ছেড়ে দেন। এ ছাড়া হাতেনাতে গ্রেপ্তার বা তল্লাশিতে যানবাহনে বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছে কোনো ধরনের ধারালো অস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র না পেলে আটক করাও সম্ভব হয় না। ছিনতাইকারীরা ভোরের সময়টিকেও ছিনতাইয়ের কাজে বেছে নেয়। এ সময় বাস, রেল ও নৌ টার্মিনালে যাত্রীরা এসে নামে। ভোরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাত্রীরা আসার সময় ছিনতাইকারীরা তাদের টার্গেট করে। রাতভর দায়িত্ব পালন শেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে থাকেন। ফলে এই সময়টাতেই বেশি সক্রিয় থাকে ছিনতাইকারীরা। আবার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় কর্মজীবী নারী-পুরুষরা যখন বের হন, তখনও ওঁতপেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার নিয়ে তাদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া কিংবা পথ আটকে সর্বস্ব কেড়ে নেয় চক্রটি। ছিনতাইকারীরা কম দামি মালামাল নিলে ভুক্তভোগীরা সাধারণত মামলা করতে চান না। কেউ কেউ শুধু সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে ভুক্তভোগীরা জানান, ছিনতাইয়ের খপ্পরে পড়ে থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলে পুলিশ নিতে চায় না। মামলা করলে কোর্ট-কাছারিতে দৌড়াতে হবে, এমন ভয় দেখিয়ে তারা জিডি করতে উৎসাহিত করে। জিডিতে সাধারণত সঙ্গে থাকা সামগ্রী হারিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করতে হয়। এসব জিডির তদন্তে তারাও আর গুরুত্ব দেয় না। ফলে বেশির ভাগেরই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন না সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা মাইক্রোবাস নিয়ে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে প্রবাসীর গাড়ি আটকে স্বর্ণালংকার ও অর্থকড়ি নিয়ে যায় এমন ঘটনাও কম ঘটছে না। শুধু রাতে ছিনতাই হয় তেমনটি নয়। দিন-দুপুরেও ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে অনেকে। মোটরসাইকেলে করে এসে ছিনতাইকারী রিকশা আরোহীর ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। এই ছিনতাই চক্রের নাম দেয়া হয়েছে টানা পার্টি। পুলিশ টহল টিম আরো তৎপর থাকলে তাদের দৌরাত্ম্য কমে আসত। তাই ছিনতাই প্রতিরোধে সার্বিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, ঢাকার প্রধান সড়কগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা, ছিনতাইকারী হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে এলে তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো গেলে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। যানজটের এই রাজধানীতে দিনের আলোকে কাজ শেষ করা কঠিন। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। আর রাতের বেলা যদি রাজধানী অরক্ষিত থাকে, তাহলে মানুষের কর্মঘণ্টা কমে যাবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত