ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঙালির অস্তিত্বের কবি কাজী নজরুল

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
বাঙালির অস্তিত্বের কবি কাজী নজরুল

সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী। একজনে দিলে ব্যথা-/সমান হইয়া বাজে, সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।/একের অসম্মান/নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!/মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,/ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান! (কুলি-মজুর)। কাজী নজরুল ইসলামের অমর স্মৃষ্টি। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সব সময় ছিল তার অবস্থান। শিল্পী সত্তায় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও গভীর উপলব্ধি ছিল তার রচনায়। গবেষকদের বিবেচনায়, যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম অস্তিত্বের প্রকৃত গড়ন সময়ের কামারশালায় বিশ্ব পরিস্থিতির তৎকালীন তাপ-চাপ, অমানবিকতার নিঃসংশয় নির্লজ্জ প্রকাশের পটভূমিতে। কাজী নজরুল ইসলাম মানতেন- ব্যক্তিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয় সমষ্টির অস্তিত্ব ও অবস্থিতি। সব ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ড জীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। তার রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ; দরিদ্র-অশিক্ষিত-ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য রুটি-কাজ আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সাজিয়েছেন কবি তার কথামালায়। নজরুল ছিলেন জনতার কাতারের দাঁড়ানো এক শক্ত মানুষ; ফাঁকবিহীন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক। কাজী নজরুল ইসলামের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাংলা কবিতায় বড় বেশি প্রয়োজন। প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাস নজরুল সম্পর্কে বলেছেন- ‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।’ কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ ছিল আলাদা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে। তাই জনদরদি রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছেন তার রচনায়। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। একদিকে যেমন বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখেছেন এবং অসহায় মানুষদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাম্যের গান শুনিয়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি কোমল হদয়ের সন্ধান দিয়েছেন। তেমনি সর্বমানবের মুক্তি এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা নজরুলের যেমন উদ্দেশ্য, তেমনি মার্কসেরও উদ্দেশ্য। তবে পার্থক্য শুধু আদর্শগত। নজরুল মার্কসের মতো বস্তুবাদী ছিলেন না। মানবসমাজের ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আলোচনাও করেননি। কেবল সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় সাম্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। এখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছেন- গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিমণ্ডক্রীশ্চান। বিশেষ এক কালপর্বে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। দেশ-কালের সঙ্গে তার অর্ন্তত্মার যে যোগাযোগ, সেই শক্তি তাকে কালান্তরে মহানায়কের ভূমিকায় আসীন করেছে। ক্রান্তি-সংকটের এই বর্তমানে নজরুল আমাদের আরো অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং নমস্য। সমূহ অন্যায়-অবিচার আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপক্ষে তার স্বভাবজ আবেগের স্পন্দন-বিলোড়নের অন্তরালে আন্তরসত্যে অঙ্গীকার ছিল সুদৃঢ়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা, তার ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে প্রহরে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ও জাতির শান্তি রক্ষায় কিংবা পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তার যে অভিব্যক্তির প্রকাশ, তা জাতীয় চেতনার প্রতি তার প্রবল বিশ্বস্ততাকেই ধারণ করে। হিংসামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ছিল তার প্রবল ঝোঁক। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূল সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের-গোত্রের বিভেদমোচন। নজরুল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অপশক্তির মূল উৎপাটনের দিকেও সচেতন মানুষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করেছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যে রাজশক্তি মানুষের প্রতি পাশবিক আচরণ করে, যে রাজশক্তি অগণন নারীকে বিধবা কিংবা সন্তানহারা করে, সেই রাজশক্তির ধ্বংস অনিবার্য। জাগ্রত জনতাই নজরুলের আরাধ্য ছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত