ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যুগসন্ধিক্ষণের মহামানব খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা

ইকবাল মাসুদ
যুগসন্ধিক্ষণের মহামানব খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাকে বলা হয় বঙ্গীয় মুসলিম নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ সন্তান। যিনি মাত্র কয়েকজন সাথী নিয়ে আহ্ছানিয়া মিশনের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা জীবনকালকে বলা হয় বাংলার মুসলমানের পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁ কাল। তাঁর মেধা-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, একই সঙ্গে সমাজের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর বিকাশে এই নবজাগরণ অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার নেতৃত্বে মুসলিম সমাজের অগ্রযাত্রার পথে যে বাঁধাগুলো ছিল তা তিনি সুদক্ষতার সাথে অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন। তার উদ্যোগসমূহ আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষকে অতিক্রম করার জন্য বঙ্গবাসীকে সাহসী আর উদ্যমী করে তোলে।

রেনেসাঁর অর্থ যদি হয় ‘early stage of modern age’ তবে বাংলার মুসলিম জাগরণের রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার হাত ধরে একথা বলেল অত্যুক্তি হয় না। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাই সর্বপ্রথম অনুভব করেন আধুনিক শিক্ষা সুদৃঢ় না হলে জাতি এগিয়ে যেতে পারবে না। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যেমন রাম মোহন রায় প্রথম অনুভব করেন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষার আলো গায়ে না মাখলে এ দেশের মানুষ আধুনিক হতে পারবে না। তেমনি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ধর্মচর্চার পাশাপাশি মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছিলেন। কারণ সে সময় মুসলিম সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মধ্যযুগীয়তা মনসিকতা কাটিয়ে উঠে অগ্রসর হচ্ছিল না।

নবাবী আমলের শেষের দিক থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত হিন্দুদের হাতেই চলে যায়, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে, ইংরেজ ঘনিষ্ট, নগরের ব্যবসা-বাণিজ্যে পয়সা কামানো নতুন উদ্ভূত ধণিক শ্রেণি-যারা প্রায় সবাই হিন্দু গ্রামের জমিদারি কিনে নতুন জমিদারে পরিণত হয়। গবেষকরা এ সময়ের মুসলিম আমলকে চিহ্নিত করেছিলেন অন্ধকার যুগ হিসেবে। ভারতের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ধ্বংস করার জন্য নব্য শিক্ষিত ভারতীয়রা মুসলিম আমলকে দোষারোপ করে এক ধরনের তৃপ্তি লাভ করতে আরম্ভ করেন।

ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে শাসনভার কেড়ে নেয়ার পরও অনেকদিন পর্যন্ত ফৌজদারি ও বিচার বিভাগে মুসলমান কর্মচারী ও মৌলভিদের প্রয়োজন হতো, কারণ ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অফিস কাছারির ভাষা ছিল ফার্সি। এই প্রয়োজন মেটাতে ১৭৮১ সালে ‘ক্যালকাটা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। ১৭৯২ সালে কাশীতে স্থাপন করা হয় ‘সংস্কৃত কলেজ’। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়, ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর উদ্দেশ্যে। ১৮১১ সালে লর্ড মিন্টো এদেশীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চার অবনতি বিষয়ে মন্তব্য করেন। বেসরকারি উদ্যোগে ‘হিন্দু কলেজ’ স্থাপন করে অভিজাত হিন্দু সমাজ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ও অনেকাংশে সফল হয়। এই পটভূমিতে ‘ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী’ গঠিত হয়। সেই সময় রাম মোহনের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা বেশ গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে তখন শিক্ষার বিকাশ ঘটেছে সামান্যই। মুসলমানরা হিন্দু স্বাজাত্যবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত বা সঙ্কিত হয়ে ১৮৬৩ সালে গড়ে তোলে ‘মহামেডান লিটারারী সোসাইটি’। এটি শিক্ষিত মুসলমানদের সংস্কার করার একটি প্রচেষ্টা ছিল। সৈয়দ আমির আলির ‘সেন্ট্রাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ এরকম আরেকটি প্রচেষ্টা। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যদিয়ে দুই সম্প্রদায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তাই এই দেশের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ এসেছে। সেসময়ের ভারতের একজন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ স্যার সৈয়দ আহমেদের অবদানও স্মরণযোগ্য। যিনি ভারতের মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। তার চিন্তাধারা ও কাজকর্ম মুসলিমদের মধ্যে একটি নতুন চেতনার জন্ম দেয়, তার প্রভাবে প্রভাবান্বিত মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা পরবর্তীতে আলিগড় আন্দোলনের সূচনা করেন যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত করা। তিনি এই কাজের জন্যই মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের প্রভাবকে বলা যায়, আলিগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। নওয়াব সলিমুল্লাহও পূর্ব বাংলায় একটি জ্ঞানবিভাসিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে পিছিয়েপড়া বাঙালি মুসলমানদের জন্য। ১৯০৬ সালের ২৭-২৯ ডিসেম্বর শাহবাগ বাগান বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় ‘অল-ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’। সম্মেলন শেষে ৩০ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। এ সময় নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ অন্য নেতাদের দাবি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। পরবর্তিতে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ঢাকা শ্বিবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

এমন এক প্রেক্ষাপটে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার আবির্ভাব ও বঙ্গীয় মুসলিম পুনর্জাগরণে তার অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। তার সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার প্রচেষ্টার সঙ্গে ধর্ম একীভূত হয়ে যায়নি। তার সংস্কারগুলো মুসলিম বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্মের ইতিহাসের মধ্যেও নিহিত ছিল। তিনি এদেশীয় মুসলমানদের জন্য পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালিন মুসলিম নেতৃত্বের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অবাঙালি মুসলমান, খুবই কম সংখ্যকই ছিল পূর্ব বঙ্গীয় বাঙালি মুসলমান। এই অল্প সংখ্যকের মধ্যে অন্যতম ছিল খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। এজন্য তিনি অন্যদের চেয়েও ভিন্নতর ছিলেন।

অবিভক্ত বঙ্গের মুসলমানের পুনর্জাগরণ কুণ্ডপ্রথা, ছুঁতমার্গ, বর্ণ বিদ্বেষ দূর করার বা ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষার কাজে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ধর্মকে বিসর্জন দেননি। বরং কোরআন ও হাদিসের মর্মবাণী তিনি পালন ও প্রচার করেছেন সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। মুসলিম সমাজ আজ যতটা কুসংস্কার মুক্ত হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে তার অনেকাংশ তারই কল্যাণেই। আজ যেসব প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, উঁচু মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের হাত ধরে বাংলাদেশ জেগে উঠেছে তার গোড়া পত্তনে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তার স্নেহ ছায়ায় বড় হয়েছেন অনেক সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবীদ। চাকরি ও অবসর জীবনে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নিরলসভাবে ধর্ম ও সাহিত্যচর্চা করেন। সমাজ, দেশ, বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম নানা বিষয় নিয়ে প্রায় শতাধিক পুস্তক রচনা করেন। তার সাহিত্য ভাবনার পুরোটা দখল করে রয়েছে স্বদেশ ও স্বজাতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং মানুষের সর্বাঙ্গিক মঙ্গল কামনা। সমাজ সংস্কার তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রতিও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। আধ্যাত্ম চর্চা ও আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের প্রতি বাল্যকাল থেকেই তার প্রবল আকর্ষণ লক্ষ্যণীয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ধার্মিক ছিলেন এবং অসম্প্রদায়িক সুফি দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি ছিলেন উদার মুসলিম জীবনবাদী দর্শনের বিশ্বাসী। ‘সৃষ্টের সেবা’ তথা সমগ্র মানব সমাজের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সেবার মহান ব্রত নিয়ে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা আজীবন আধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তার জন্মের ১৫০ বছর পরেও সৃষ্টির জয়রথের গতি আজও শ্লথ হয়নি, বরং নতুন শতকে তার আদর্শে নতুন প্রজন্ম নতুনভাবে উজ্জীবিত হচ্ছে।

লেখক : পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং সদস্য, নির্বাহী কমিটি, নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত