ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশবান্ধব পরম বন্ধু সাইকেল

মো. ফরহাদ আলী শুভ
পরিবেশবান্ধব পরম বন্ধু সাইকেল

আসলেই জীবনের চাকা ঘুরলেও তা অন্যভাবে ঘোরে। প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে খুঁজে পাওয়া যায় সাইকেল দ্বিচক্রযানটির মতো বিভিন্ন বাহনের। একসময় বাঙালি সমাজে মেয়েদের বিয়ের পীড়িতে জামাই বাবুর জন্য বাইসাইকেল ছিল যৌতুকের প্রধান উপঢৌকন। এই বাইসাইকেল কত না মেয়ের জীবনে কাল হয়েছে, কত না প্রেমিক তার প্রেমিকার মন জয় করেছে, এই বাইসাইকেলে করে চিঠির আদান-প্রদানে। কত না মনীষী এই বাইসাইকেল দিয়ে জীবন শুরু করে আজ বিশ্ববিখ্যাত বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের গাড়িতে চড়ে। কত না শিক্ষার্থী বন্ধু এই বাইসাইকেল দিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, বলুন পুরোনো সোনালি স্মৃতি কি ভোলা যায়!

সাইকেলের প্যাডেল যেন আজও জীবনের প্যাডেল হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের দিনগুলোকে। সাইকেল কিন্তু হারিয়ে যায়নি। আজও দর্পহাতে শক্তভাবে নারী-পুরুষের মনের মণিকোঠায় গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে অদ্ভুতভাবে টিকে আছে। হয়তোবা আরেকটু রোমান্টিক হয়ে প্রসারিত হলে অতীত ফিরে পেত। হয়ত প্রযুক্তির দাপটে তা হচ্ছে না। কিন্তু পরিবেশের রক্ষায় তার ভূমিকা আবারও জানান দিয়ে তার কাছে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। বাইসাকেল পরিবহন, বিনোদন, ব্যায়াম বা খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করা হয়। সাইকেল চালানোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ‘সাইকেল চালক’ বা ‘বাইকার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দ্বি-চাকার সাইকেল ছাড়াও ‘সাইকেল চালানো’ এর মধ্যে রয়েছে ট্রাইসাইকেল, ইউনিসাইকেল, কোয়াড্রিসাইকেল, রেকম্বেন্ট এবং অনুরূপ মানব-চালিত যানবাহন। দ্বিচক্রযান নামে পরিচিত সাইকেল ১৯ শতকে উদ্ভাবিত হলেও সারাবিশ্বে এখন প্রায় ১.২ বিলিয়নের মতো লোক বাইসাইকেল ব্যবহার করে। বিশ্বের অনেক দুর্গম জায়গায় এটি এখনো প্রধান পরিবহনের মাধ্যম। বিশ্বের অনেক অংশে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ ইউরোপীয় শহরগুলোতে পরিবহনের প্রধানমাধ্যম। বাংলাদেশের বাঙালির অভিধানে সাইকেল যেন গানে গল্পে জীবনের শিরা-উপশিরায় গ্রামগঞ্জে ও শহরে অদ্ভুত বন্ধনে মিশে আছে। সাইকেল সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, ধর্মীয়, যুদ্ধ বিগ্রহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা ধরে রেখেছে ইতিহাসের পরম্পরায়, এখন কিছুটা কমে গেছে মানুষের সদিচ্ছার কারণেই বলতেই হয় যা ভুল সিদ্ধান্ত। সাইকেল চালানোকে ব্যাপকভাবে পরিবহনের একটি কার্যকরী এবং দক্ষমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা স্বল্প থেকে মাঝারি দূরত্বের জন্য সর্বোত্তম। সাইকেল যেন পরিবেশের পরমবন্ধু ও সংস্কৃতির আত্মার আত্মীয় হয়ে রয়েছে। সাইকেল পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কেনো তা আলোচনায় নিয়ে আসি। সমাজে সাইকেল চালানো জীবাশ্ম জ্বালানির স্বল্প খরচ, বায়ু এবং শব্দদূষণ, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং যানজটকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করায় ভূমিকা রাখে। ট্রান্সপোর্ট সেক্টর থেকে পৃথিবীর মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমনের প্রায় ১৫ শতাংশের কাছাকাছি বেরোয়। আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের একটা কিয়দংশ সামান্য পরিবর্তন করলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি। কিছু দিন আগে আমি ২০২০ সালের একটি রিপোর্টের কিয়দংশ স্টাডি করি যাতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিশ্চিয়ান ব্র্যান্ডের নেতৃত্বে পৃথিবীর সাতটি শহরজুড়ে প্রায় চার হাজার মানুষের ওপরে করা একটি গবেষণা থেকে জানতে পারি। যদি আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের একটি মাত্র ট্রিপ গাড়ি ব্যবহার না করে সাইকেল ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকের ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে গ্রিন হাউজ গ্যাসের এমিশন প্রায় ৬৭ শতাংশ কমানো যেতে পারে। এই গবেষণা সমীক্ষাতে আরো জানা গেছে, যদি জনসংখ্যার মাত্র ১০ ভাগ মানুষ দিনে একটি করে ট্রিপ গাড়ির বদলে বাইসাইকেলে করেন, সে ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাবে। এই সমীক্ষায় একটি চমক জাগানো তথ্য হলো, আমরা কাজের থেকে অকাজে (বাজার করা বা ঘুরতে যাওয়া, অপ্রয়োজনে আমোদ ফুর্তি) গাড়ি বেশি ব্যবহার করি। অর্থাৎ যেখানে হাতে সময় নিয়ে বেরোলে অনায়াসে হেঁটে বা গণপরিবহনে বা সাইকেলে, রিকশায় যাতায়াত করা সম্ভব, সেই সব জায়গায় আমরা প্রতিনিয়ত গাড়ির ব্যবহার করে আসছি। কাজের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতার কারণে যদি আমরা গাড়ি ব্যবহার করি ও বাকি ক্ষেত্রবিশেষে রিকশা ও সাইকেল ব্যবহারে আমাদের ব্যক্তিগত গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ প্রভূত পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি। সাইকেল চালানো থেকে অর্জিত শারীরিক ব্যায়াম সাধারণত স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার সঙ্গে যুক্ত। সচেতনতা, সদিচ্ছা ও হামবড়া ভাব থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে কিছু কিছু সময় সাধারণ জনগণের কাতারে আসতে হবে। তবেই প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার হবে আমাদের স্বপ্নের মানবিক সমাজ গড়ায়। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন ও ধনীদের বিলাসিতাকে উৎসর্গ করলে সমাজের ইতিবাচক সংস্করণে পরিবেশবান্ধব চিন্তায় প্রায়োগিক হবে আশা করা যায়। তারপর বড় কথা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমকে আরো গোছানো হতে হবে একটা অভিযানের মাধ্যমে। হয়তো লোকসান হবে কিছু মানুষের, কিন্তু পরিবেশ ও জলবায়ুগত দিক দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মঙ্গল হবে। একটা লোকসান হাজারটা ভালো ও ইতিবাচক অবস্থা বয়ে নিয়ে আসবে সমাজের জন্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত