ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভাষা এক বহমান নদী

অলোক আচার্য
ভাষা এক বহমান নদী

ভাষা এক বহমান নদীর মতো। মানুষ বেঁচে থাকলে ভাষার দরকার হয়। নদী যেমন চলতে চলতে যদি বাঁধা পায়, তাহলে থেমে যায়। ভাষাও তেমন। চলতে চলতে বাঁধা পেলে থেমে যায় ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। মা, মাতৃভাষা, দেশের প্রতি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। থাকে দায়িত্ব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চরম আত্মত্যাগের মধ্যেদিয়ে ভাষার স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বহু দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই সময় থেকে মাতৃভাষা নিয়ে চর্চা, গবেষণা হচ্ছে। তবে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। সর্বত্রই ভাষার ভুল বানান, শব্দের প্রয়োগে সঠিকতার অভাব এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা মিশিয়ে বাংলার শুদ্ধতাকে নষ্ট করার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ভাষার স্বাধীনতা অর্জন করেছি এখন দায়িত্ব শেষ! বাংলা হলো বিশ্বের মধুর থেকে মধুরতম ভাষা। বিভিন্নভাবে ভাষার বিকৃতি হচ্ছে আমাদের দেশে। মোবাইলের ম্যাসেজে, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে। দোকানে দোকানে ইংরেজি নাম দেখে মনে হয় ইংরেজি নামেই তারা বেশি স্বস্তি পায়! অথচ ইচ্ছা করলেই নামগুলো বাংলায় হতে পারত। আমরা আজ বাংলায় কথা বলছি, সে তো গর্বের বিষয়। পরভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তার থেকে বাংলা মায়ের সাহসী ছেলেরা রাস্তায় নেমে, আন্দোলন করে, বুকের রক্ত দিয়ে নিজের ভাষা ছিনিয়ে এসেছিল। এরপরও ভাষা সঠিকভাবে চর্চায় এত অনীহা কেন থাকবে? একটি অবহেলায় ভুল শব্দ যে দৃষ্টিকটূ তা বুঝতে হবে? এছাড়া আরো অনেকভাবেই ভাষার বিকৃতি হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আরো পদক্ষেপ ও সচেতনতা জরুরি। আামদের ভাষা প্রাপ্তির ইতিহাস রক্তের, আন্দোলনের। ফেব্রুয়ারি এলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কথা। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে ফিচার ও টক শো অনুষ্ঠিত হয়। মনে হয় সব সমস্যার সমাধান হয়তো এ বছর করা হবে। কিন্তু হয় না। সেই ভুল সেই বিকৃতিই বছরজুড়ে চলতে থাকে। বাংলা সমৃদ্ধশালী ভাষা হলেও আমাদের কারণেই কোথায় যেন একটা ঢিলেঢালা ভাব চোখে পরে। হতে পারে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি ভাষা বললে প্রথমেই আসে ইংরেজি ভাষার কথা। এই ভাষাকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় যে, মনে করা হয় এটা ভালোভাবে আয়ত্ব না করলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। তার মানে এই না যে, ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব নেই। তাই বলে নিজ ভাষা চর্চার উপরে অবশ্যই নয়। ছোটবেলা থেকে আমি বা আমার সহপাঠীরা যে লেখাপড়া করে বড় হয়েছি, সেখানে সারা বছরই আমাদের ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। তারপরেও যে বিষয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ফেল করেছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ইংরেজি। শ্রেণিতে প্রায়ই পড়া না পারার জন্য বেতের পিটুনি ছিল নির্ধারিত। তাও কিন্তু বেশিরভাগ সময় ওই ইংরেজি ক্লাসেই খেয়েছি। অর্থাৎ সারা জীবনটাই কিন্তু বিদেশি ভাষা রপ্ত করতে করতে কাটিয়ে দিলাম; কিন্তু তারপরেও এই ভাষার উপর ক’জনে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি। অনেকেই তো কোনমতে শিখে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। শুধু স্কুলে কেন বাড়িতেও তো বাবা-মা সবাই সারাক্ষণ ইংরেজি পড় ইংরেজি পড় করেছে। বাংলাটা মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত, এরকম কথা পরিবারে বা স্কুলে খুব কম শুনেছি বলেই মনে হয়।

সাইনবোর্ড, নামফলক, বিলবোর্ড বাংলায় লেখার কথা থাকলেও তার কোনো তদারকি বা মেনে চলার আগ্রহ নেই। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা চর্চার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। তবে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকেছে বরাবর। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষা চর্চা এবং সর্বস্তরে প্রয়োগের বিষয়ে ব্যপক আলোচনা হয়। তারপর সারাবছর আবার সেই এক অবস্থা। দেশের শহরে বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে বাংলা প্রাধান্য না পেয়ে ইংরেজিটাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ছাত্রছাত্রীদের দেখি সকাল-বিকাল ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান নিয়ে প্রাইভেটের পর প্রাইভেট পড়ছে। তা পড়ুক। অন্য ভাষা বা অন্য বিষয়ে চর্চায় তো আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আপত্তি শুধু একটুখানি সময় আমার মায়ের ভাষার পেছনে ব্যয় করা। কি মধুর যে এই ভাষা তা নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা তো আর হয়ে ওঠে না। আমার জানা মতে পৃথিবীর ২০ কোটিরও অধিক লোক বাংলায় কথা বলে। এটা ভাবতেই ভালো লাগে। অন্য ভাষা রপ্ত করতে গেলেও যে নিজ বুলিটা উত্তমরূপে আয়ত্ব করার প্রয়োজন হয়, সেকথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। বাইরের দেশের ভাষা শেখার একটা গুরুত্ব রয়েছে; কিন্তু তা কখোনই মাতৃভাষাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। যদি তা হয়, তবে তা আত্মঘাতী। ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বংলা ভাষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কতখানি তা পরিমাপের একটা চেষ্টা করা হয়। আসলেই বিষয়টা এমন হওয়া উচিত? সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। অনেক দোকানের ব্যানারে, রাস্তাঘাটের বিভিন্ন লেখায়, দেওয়ালে দেওয়ালে তাকালে চোখে পরে বানান ভুলের ছড়াছড়ি। দেখলে মনে হয় এরা যেন ভুল বানানের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অবশ্য বাংলা বানান সঠিক লেখার উপর শহরের স্কুলগুলোতে কি হয়, তা জানি না। তবে মফস্বলের অনেক স্কুলেই যে বিষয়টার প্রতি সুনজর দেয়া হয় না, তা জানি। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যম, মোবাইলে বাংলিশ টাইপের এসএমএস দেখলে আমার ঠিক কি পরিমাণ কষ্ট হয় তা বলে বোঝাতে পারব না। দোকানের নাম বড় বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে, ডিশ লাইনে স্ক্রলে যে বিজ্ঞাপন যায়, তাতে অর্ধেক বানানই ভুল থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বানান শুদ্ধভাবে পড়ানোর প্রবণতা আগের থেকে কমে গেছে। মোটকথা ভাষাকে শুদ্ধভাবে পড়া ও লেখার চর্চা করাটাও যে ভাষার প্রতি এক ধরনের সম্মান সেটা বুঝতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার কবে কার্যকর হবে জানি না।

আমাদের অনেক বড় বড় অফিসগুলোতে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তার অবশ্য কারণও আছে। যে বিদেশি ভাষা ভালো বলতে পারবে, সোসাইটিতে তার দামও আজকাল বেশি দেয়া হয়। কিন্তু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারা একজন বাঙালির দাম কতটা। কবি সেই কবেই মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করে গেছেন। প্রথম জীবনে পরভাষায় সাহিত্য চর্চাকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বুঝতে পেরেছিলেন শিকড় ছেড়ে যে কাণ্ডের খোঁজে ছুটেছিলেন তার কি যন্ত্রণা। দেশে ফেরার পর তো তার কলমের শুধু ইতিহাস। মাতৃভাষার গুরুত্ব এত সাবলীলভাবে তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন তা সবার জানা। সনেট কবিতার জন্ম দিয়ে তিনি আলাদা একটা ধারার জন্ম দিলেন। নিজের ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে না পারলে ভিনদেশি ভাষা যে আয়ত্ত করা কঠিন সে অতি খাঁটি কথা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সেই মহান আত্মত্যাগ, সারা বিশ্বে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ¯ী^কৃতি এসবকিছুই বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো যথেষ্ট। এছাড়াও এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে। আমরা দরিদ্র নই। আমরা সমৃদ্ধ। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ। দরকার শুধু মুখের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর দিয়ে লালন করার ক্ষমতা। দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার সঠিক ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ হলে ভালো হয়। আমি বারবার বলছি বর্তমান যুগে চলতে গেলে বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে; কিন্তু তা যে কোনোভাবেই মাতৃভাষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে তা আমি মানতে নারাজ। আমাদের প্রজন্ম ,আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র ইংরেজি বা অংক বা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি ভীতিসূচক গুরুত্ব না দিয়ে পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ এসব বিষয়কে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি যে মমতা তা খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু করা উচিত বলে মনে হয়। ভাষা আমাদের অহংকার। একুশ এলেই ভাষা নিয়ে যে তোড়জোড় চোখে পরে তার কিছুটা যদি সারা বছর থাকত, তাহলে আজ বাংলা ভাষার ব্যাবহারের ভ্রান্তি নিয়ে এত কথা হতো না। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিয়ে এত কষ্ট করতে হতো না। একুশে ফেব্রুয়ারি যত না পালনের তার চেয়ে বেশি আড়ম্বরের হয়ে যাচ্ছে। মানেটা হলো দিন শেষ তো সব শেষ। সারা বছর আবার সেই ভুল, আবার বিদেশি ভাষার প্রাধান্য। দিবস পালনের উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই আমাদের। কিন্তু তার সঙ্গে ইতিহাসটাও জানতে হবে। ব্যানার, লিফলেট, সাইনবোর্ড, দেওয়াল সব জায়গাতে ভুল। অথচ শুদ্ধ ও সঠিক চর্চার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আমরাই এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা তো সারাক্ষণ হিন্দী, ইংরেজি চর্চা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাই। লেখাপড়া করছি তো সঠিক ইংরেজি শিখতে হবে। হিন্দি সিরিয়াল বা সিনেমা দেখতে হবে। বাংলার উপর গুরুত্ব দেবার সময় কোথায়। তাহলে বাংলা শিখবে কীভাবে। ভুল বানান হলে তা ধরিয়ে দেবার লোক নেই। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলা ভাষারূপ এই নদীকে আমাদেরই এগিয়ে নিতে হবে। এ দায়িত্ব তার সন্তান ছাড়া আর কার থাকতে পারে?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত