ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবনের যোগ-বিয়োগের ফলাফল অতঃপর...

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
জীবনের যোগ-বিয়োগের ফলাফল অতঃপর...

বাবার লাশ উঠানে বা বাইরে রেখে সম্পত্তি নিয়ে সন্তানদের ভাগাভাগির ঘটনা প্রায়ই শুনছি গণমাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে একটা খবর অনেকের মনে নাড়া দিয়েছে। খবরটি হলো- খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় মেয়েদের ফাঁকি দিয়ে ছেলেকে জমি লিখে দেওয়ায় সাকাত গাজী নামে বৃদ্ধার লাশ দাফনে বাধা দিয়েছেন মেয়েরা। লাশটি তিন দিন উঠানে পড়েছিল। উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবশেষে দাফন সম্পন্ন হয়।

উপজেলার ঘোষাল গ্রামের সাকাত গাজী গত মঙ্গলবার ভোরে একটি হাসপাতালে মারা যান। তার লাশ সকাল ১০টায় বাড়িতে নিয়ে আসেন ছেলে মামুন গাজী। সাকাত গাজীর ১ ছেলে ও ৫ মেয়ে। তিনি অসুস্থ হলে ছেলে মামুন গাজী তার বোনদের ফাঁকি দিয়ে বিষয়-সম্পত্তি লিখে নেয় বলে তার বোনেরা অভিযোগ করেন। বাবার লাশ বাড়িতে এনে মামুন দাফন করার ব্যবস্থা করতে থাকেন। এ খবর পেয়ে তার বোনেরা বাড়িতে এসে লাশ দাফনে বাধা দেন। খবর পেয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ এলে মামুন তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত লাশ উঠানে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। উপজেলার ঘোষাল জামে মসজিদের ইমাম বেলাল হোসেন গত মঙ্গলবার সকালে ওই বাড়িতে গেলে মেয়েরা অভিযোগ করলে মেয়েদের হক নষ্ট করায় তিনি ও এলাকাবাসী জানাজা পড়াতে রাজি হননি। গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আল-আমিনকে জানালে তিনি ব্যবস্থা নিতে থানা পুলিশকে বলেন। (তথ্যসূত্র : ১ ডিসেম্বর, ২০২৩, যুগান্তর)। এ ঘটনায় একটা বিষয় হলো- যদি এমন হয় সন্তানদের পিতা সাকাত গাজী মেয়েদের হক নষ্ট করে একমাত্র ছেলেকে সব সম্পত্তি লিখে দেন, তাহলে কাজটি মোটেও ভালো হয়নি। অপরপক্ষে, যদি এমনটাও হয় যে, পিতা সাকাত গাজী অসুস্থ হলে কৌশলে একমাত্র ছেলে সব সম্পত্তি লিখে নেন পিতার কাছে, তাহলে সেটার দায়ভার সাকাত গাজীর কাঁধে কেন! আবার বাস্তবতা এমনো হতে পারে যে, পাঁচজন মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে (বিয়ের ব্যয় বাবদ) সাকাত গাজীর প্রায় সব সম্পত্তিই হারিয়েছে। বাকি সামান্য সম্পত্তি একমাত্র ছেলের অবলম্বনের জন্য সাকাত গাজী লিখে দিয়েছেন, এসব অনুমান। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক সন্তানদের জন্য পিতা-মাতার আত্মত্যাগের কোনো মূল্য সন্তান দিতে পারে না। মৃত পিতার লাশ দাফনে বাঁধা দিয়ে তিনদিন ধরে উঠানে ফেলে রেখে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ৫ কন্যার কাণ্ডটা রীতিমতো নীতি বিবর্জিত কাজ। ৫ কন্যাকে ছোটবেলা থেকে বড় করে বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যত ত্যাগ সাকাত গাজীর সব কি বৃথা! এমন প্রশ্ন বিবেকবান অনেকের মনে। দিন দিন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে- আমাদের মানবিক মূল্যবোধ! এমন ঘটনাগুলো সমাজের ভালো কিছু ইঙ্গিত করে না বরং সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধিতে উৎসাহ জোগায়। আরেকটি খবর আমাদের খুব বিস্মিত করেছিল চলতি বছরের আগস্ট মাসের ঘটনা। ঘটনাটি হলো- ‘৮৬ বছর বয়সি হামিদ মোল্লা ও ৭৭ বছর বয়সি ফজিলা খাতুন। এতদিন ৫ ছেলের সংসারে ভাগাভাগি করে থাকতেন তারা। সম্প্রতি এই বৃদ্ধ দম্পতি চলার শক্তি অনেকটা হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেদের কাছে বোঝা হয়ে যান বৃদ্ধ বাবা-মা। তাদের ভরণপোষণ নিয়ে শুরু হয় ছেলেদের মধ্যে টানাহেঁচড়া। একপর্যায়ে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দুর্গম চরের একটি নির্জন কবরস্থানের পাশে ফেলে রেখে যান তাদের ছেলেরা। খবর পেয়ে স্বামীহারা বড় মেয়ে বাবা-মাকে বাড়ি নিয়ে যান। ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের যমুনা বিধৌত চৌহালীর দুর্গম চরাঞ্চল উমারপুর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া গ্রামে। এদিকে খবর পেয়ে বৃদ্ধ দম্পতির পাশে দাঁড়িয়েছে উপজেলা প্রশাসন। চৌহালীর ইউএনও মাহবুব হাসান সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দিয়ে তাদের কাছে অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছেন। তাদের ঘর তুলে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাবা-মাকে ভরণপোষণ না করার অপরাধে ছেলেদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম মোল্লাও তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। হামিদ-ফজিলা দম্পতির পাঁচ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বাশার জুট মিলের শ্রমিক, দ্বিতীয় জাহাঙ্গীর ও তৃতীয় ছেলে কহিনূর রিকশাচালক, চতুর্থ ছেলে সাঈদ জুট মিলের কর্মচারী এবং ছোট ছেলে বুদ্ধু পরিবহন শ্রমিক। তারা এত দিন ভাগাভাগি করে মা-বাবাকে দেখাশোনা করে আসছিলেন। যমুনার ভাঙনে একেক ছেলে একেক এলাকায় বাড়ি করে বসবাস করছেন। দিন দিন মা-বাবার প্রতি অযত্ন ও অবহেলা বাড়তে থাকে। কে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে, এ নিয়ে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। প্রথম দিকে মানিকগঞ্জে তৃতীয় ছেলে কহিনূরের বাড়িতে থাকতেন তারা। দুই মাস আগে তাদের হাঁপানিয়া চরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ভাগনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন আশ্রয় পেয়েছিলেন বৃদ্ধ হামিদ ও তার স্ত্রী। কিছুদিন না যেতেই অবহেলা শুরু হয়। এরপর বড় মেয়ে মনোয়ারার বাড়ি সংলগ্ন শম্ভুদিয়া কবরস্থানে বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে যান ছেলেরা। মনোয়ারা খাতুন বলেন, বৃদ্ধ বাবা-মাকে উদ্ধার করে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আমি নিজে স্বামীহারা। সন্তানদের সংসারে থাকি। এ অবস্থায় মা-বাবার দেখাশোনা করা খুবই কষ্টকর। চৌহালী থানার ওসি হারুন-অর-রশিদ বলেন, কেউ এখনো মামলার জন্য আসেননি। বৃদ্ধ দম্পতির আত্মীয়স্বজনকে থানায় আসতে বলা হয়েছে। (সূত্র : ২৬ আগস্ট, ২০২৩, দৈনিক মানব জমিন)। ঘটনাটির একপর্যায়ে সুরাহা হয়েছিল।

সমাজে দিন দিন এসব কি হচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা আজ কেন এত তলানিতে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে চিরাচরিত নিয়মে পিতা-মাতা সন্তানদের কাছে আদর-সম্মানের সঙ্গে বাকি জীবন অতিবাহিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজের কিছু ব্যতিক্রম রুচির সন্তানরা বৃদ্ধ-পিতার ভরণপোষণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এমনকি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পরিবারের বোঝা মনে করে। এমনো দেখা যায় দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যে বৃদ্ধ সদস্যরা রয়েছে তাদের অনেকের সন্তান সাবলম্বী বা ভালো মানের চাকরিজীবী। স্বাবলম্বী সন্তান থাকা সত্ত্বেও ওই সন্তানদের বাসায় কাজের লোক দুমুঠো ভাত পেলেও সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার বৃদ্ধ পিতা-মাতার ঠাঁই হয় না সংসারে। তাই এই হতভাগা পিতা-মাতাদের জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম। বেঁচে থাকলে জীবনের পড়ন্ত বিকাল সবার জীবনে অবধারিত। যে ছেলে আজ নিজের কিংবা স্ত্রীর বুদ্ধিতে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সংসারে রাখেনি, বোঝা মনে করে অবহেলা করছে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে, সে ছেলের কি জীবনের পড়ন্ত বিকাল আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে। শুধুমাত্র সময়ের ব্যবধান। প্রতিটি মানুষেরই জীবনের সকাল-বিকাল আছে। আজ যে সন্তান পিতার লাশ দাফন করতে অবহেলায় দেড়ি করে, সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, কাল সেই সন্তানেরও পড়ন্ত বিকাল আসবে, তখন কেমন আচরণ করবে তার সন্তান, সেটা কি একবারও চিন্তা মাথায় আসে না! জীবন সামান্য যোগ-বিয়োগের হিসাবটা বড়ই কঠিন। যাদের হিসাবটা মিলে যায়, তারাই সফল।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত