ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

প্রতিদিন সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম। টেলিভিশনে খবর দেখলে কিংবা পত্রিকার পাতা খুললে সড়ক দুর্ঘটনার খবর দেখে বিষণ্ণ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। যান্ত্রিক যুগের মানুষ ধেয়ে চলছে যান্ত্রিক গতিতে। সেই যান্ত্রিক যানের তলায় পড়ে আবার জীবনও দিতে হচ্ছে তাকে। কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটোছুটি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, যন্ত্র দানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে সেই আবিষ্কারক মানুষকে। মানব সভ্যতায় এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্যময় চিত্র। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকার বা চালকদের দায়িত্ব নয়, বরং দেশের সকল মানুষের দায়িত্ব। পথচারী থেকে শুরু করে সকল নাগরিকের দায়িত্ব। সবাইকে নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিরাপদ সড়ক উপহার দেয়া আমাদের সকলের ঈমানি দায়িত্ব। আর যতো দিন যাচ্ছে, দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। থেমে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় আগামীর স্বপ্ন। কেই যেন দেখছে না। শুনছে না স্বজনদের আহাজারি। এতো নিয়ম ও আইন তবুও থামানো যাচ্ছে না এই যাত্রা। আর মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়েছে, এটা তখনই বলা যায়, যখন এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সেটি ঘটে। কিন্তু দেশের সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতিটি আনাচে-কানাচে এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে এবং এ বিষয়ে বছরের পর বছর সরকারি তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, জনসাধারণের ক্ষোভ ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থাকলে, সেটাকে আর ‘দুর্ঘটনা’ বলা যায় না। বরং সেটা হয়ে যায় অবহেলাজনিত ‘হত্যা’। আইন অনুযায়ী এগুলো প্রতিহত করার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই এর জন্য দায়ী। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের এ ধরনের গুরুতর অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা উচিত। দেশে যদি স্বাধীনভাবে আইনের শাসন প্রচলিত থাকত, তাহলে সেটা সম্ভব হতো। অনেকের ভাগ্যে সড়কে হত্যার বিচারতো দূরের কথা ক্ষতিপূরণটাও মিলছে না। আবার অনেক মানুষতো জানেই না সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়। রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) সড়ক হত্যা দিবস। ২০২৩ সালে সড়কে মৃত্যুর পরিসংখ্যান : ২০২৩ সালে দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১১২৮ জন শিশু, যা মোট নিহতের ১৭ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ৯৭৪ জন নারী, যা মোট নিহতের ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। এছাড়া সমাপ্ত বছরে ২ হাজার ৫৩২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৮৭ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ। বছরজুড়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে ১ হাজার ৯৬৭টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৯৪ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৩৪৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৮৮ জন। বছরে ১০৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৪৮ জন নিহত, ৭২ জন আহত এবং ৪৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত এবং ২৯৬ জন আহত হয়েছেন। ২০২২ সালে দেশে ২ হাজার ৯৭৩টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। সে হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ১ দশমিক ২ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে প্রাণহানি ১৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কমেছে। আর বিদায়ি ২০২৩ সালে সড়কপথে ছোট-বড় ৩৩ হাজার ৪৬৫টি দুর্ঘটনায় আহত ৪৯ হাজার ৯৯ জন এবং নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৯২। একই সময়ে নৌপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯০৫টি। এতে আহত ১ হাজার ৩১৪ ও নিহতের সংখ্যা ১৯৬। রেলপথ দুর্ঘটনা ১ হাজার ১৯৬। এতে আহত ১ হাজার ৫৯ ও নিহত ২৫৭ জন। গত বছর বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিদায়ি বছরে সাড়ে ৩৩ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। রোববার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি সংস্থা ‘সেভ দ্য রোড’ বাৎসরিক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ২৫২টি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৮১৪ জন, নিহত ৯০৪ জন। ৯ হাজার ৮৬৭টি ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত ১০ হাজার ৮৩৪ এবং নিহত ৯৩৪ জন। নির্ধারিত গতিসীমা না মানা, পরিবহন মালিকদের উদাসীনতা ও সতর্কতা অবলম্বন না করা, বিশ্রাম ছাড়া ১২-২০ ঘণ্টা গাড়ি চালানোয় ১১ হাজার ৩৪৬টি বাস দুর্ঘটনায় আহত ১৩ হাজার ১৮৫ এবং নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২৪৩ জন। দায়িত্বে অবহেলা, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের দুর্নীতিসহ বিভিন্নভাবে সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ বাহন নাসিমন-করিমন এবং অন্যান্য ৩ চাকার বিভিন্ন ধরনের বাহনে ১১ হাজার ১০৪টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৭০৮ এবং নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৫১১ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণহানি ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন ৫৮ হাজার। আর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় : বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা এক আতঙ্কের নাম। দুর্ঘটনায় খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা খুললে খবর পাওয়া যায় সড়ক দুর্ঘটনার। এসব খবর অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা মনে করি, সরকারের একার পক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সবার ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা দরকার। গণমাধ্যম, সুধীসমাজ, বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, ছাত্রসমাজ, যাত্রী, চালক, পথচারীসহ রাষ্ট্রের জনগণকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ সরকারই নিতে পারে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু সেসব আইনের প্রয়োগ নেই। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের আরো কঠোর হওয়া উচিত। আর সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্বপ্রথম সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে বের করা আবশ্যক। প্রধান কারণ হচ্ছে অসচেতনতা। এ ছাড়া রয়েছে অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা, দুর্নীতি, চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ভঙ্গুর সড়ক, ওভারক্রসিং, অতিরিক্ত গতি, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি, অনিয়ম, বিপজ্জনক ট্রাক, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালক এবং বেপরোয়া গাড়ি চালানো

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত