ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভালোবাসা দিবস ও সামাজিক অপসংস্কৃতি

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
ভালোবাসা দিবস ও সামাজিক অপসংস্কৃতি

সারাবিশ্বে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসটাকে মোটামুটিভাবে কিছু দেশ ব্যতীত অন্যসব দেশ পালন করে। আমাদের দেশের মোটামুটি এ দিবসের পালন উৎসব আমরা দেখতে পাই, বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এ দিনে বিনোদনকেন্দ্রগুলো খুব ভরপুর থাকে এই দিবসকে ঘিরে। এই দিবসকে ইংরেজিতে ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ হিসেবে আমরা জানি। ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এই দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে নয়, বরং অনেকের সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগে তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দি করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল, আর নৈতিকতার অবক্ষয়ও রোধ করা প্রয়োজন ছিল। বন্দি অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এর পেছনে কালো সত্যি আরো ভয়াবহ, সেই অন্ধ মেয়েকেও ইনি অবৈধ সম্পর্ক ছাড়া ছাড়েন না। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। আর তাই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। খ্রিষ্টান জগতে পাদ্রী-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে। যেমন- ২৩ এপ্রিল সেন্ট জজ দিবস, ১১ নভেম্বর সেন্ট মার্টিন দিবস, ২৪ আগস্ট সেন্ট বার্থোলোমিজম দিবস, ১ নভেম্বর আল সেইন্টম দিবস, ৩০ নভেম্বর সেন্ট এন্ড্রু দিবস, ১৭ মার্চ সেন্ট প্যাট্রিক দিবস।

পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মূখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খ্রিষ্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদ্?যাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে সেদেশের আদালত। বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদ্?যাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করে এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। এ দিবসের অনেক ইতিহাস থাকলেও বর্তমানে দিবসটিকে ঘিরে চলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নোংরামি। বিশেষ করে এ দিবসটি যেহেতু উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী ও শিক্ষার্থীদের পালনের হিরিক, তাই তাদের উপরেই খারাপ দিকগুলোর প্রভাব শুরু হয়। তারপর এর বিরূপ প্রভাব অভিভাবক তথা সমাজে বিস্তর লাভ করে।

ইসলাম ধর্মে দিবসের নামে বেহায়াপনা, অশ্লীলতাণ্ডনোংরামি গ্রহণযোগ্যতা নেই। স্বভাবতই খারাপ কিছুকে কোনো ধর্মেই সাপোর্ট করে না। এ দিবসের পরের দিন কিংবা তার কয়েকদিন পরে আমরা পত্র-পত্রিকা কিংবা গণমাধ্যমে জানতে পারি, অনেক ন্যাক্করজনক ঘটনা যা এ সমাজকে কলুষিত করছে। বিগত দিনেও এ দিবসের অপসংস্কৃতির বলি হয়েছে অনেক তরুণী। ২০২০ সালের খুলনার একটি ঘটনা তৎকালীন সময় খুব আলোচিত হয়েছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন সপ্তম শ্রেণির একছাত্রী। কিন্তু বন্ধুত্বের সরল বিশ্বাসের কাছে প্রতারিত হয়েছিলেন তিনি। সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পর তিন বন্ধু পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে তারা। সেই ভিডিও দিয়ে মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলারও চেষ্টা করে। ঘটনাটি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনীমহল এলাকায় ঘটেছিল।

স্থানীয় একাধিক সূত্র বলেছে, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুরে ফুপুর বাড়ি থেকে সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় চন্দনীমহল এলাকার শাহিন (২৬), তার বন্ধু কাজল ও তাজুল মল্লিক। বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর পর রাতে শাহিন ও তার বন্ধুরা চন্দনীমহল এলাকার শরিফুলের বাড়িতে নিয়ে মেয়েটিকে রাতভর ধর্ষণ করে। এ সময় ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে শরিফুল। পরে তাকে কাঁটাবন এলাকায় ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে’। ( তথ্য সূত্র : ইনকিলাব, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)।

ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা বৃদ্ধি নয় বরং মানুষকে নৈতিক অবক্ষয়, অশ্লীল ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে। অভিভাবকরা সঠিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকলে হয়তো বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দেখতে হতো না। দিনটিতে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তথা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা তো সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। তরুণ-তরুণীরা নিজেদের রূপসৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। উঠতি মেয়েরা রূপান্তরিত হয়ে জৈবিক কামনা ও যৌনতার খোরাকে রূপ নেয়, প্রতারিত হয়ে অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে। অঙ্কন পটীয়সীরা উল্কি আঁকার জন্য পসরা সাজিয়ে বসে থাকে রাস্তার ধারে। তাদের সামনে তরুণীরা পিঠ, বাহু আর হস্তদ্বয় মেলে ধরে পছন্দের উল্কিটি এঁকে দেয়ার জন্য। তারপর রাতব্যাপী চলে নীরবে-নিভৃতে প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে খোশ গল্পসহ কত কি! এ হলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কর্মসূচি! একে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস না বলে বিশ্ব অপসংস্কৃতি দিবস বললে অন্তত নামকরণটি কিছুটা হলেও যথার্থ হতো। এই দিবসের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে নিজে বিপদে, সঙ্গে পরিবার তথা সমাজকেও বিপদের দিকে ঢেলে দিচ্ছে। দিবসটির ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা মাথায় রেখে সন্তানের অবিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। প্রশাসনিকভাবে দিবসটিতে নোংরামি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত