ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যৌন নিপীড়নের শাস্তি বাধ্যতামূলক ছুটি!

শিক্ষক নিয়োগের আগে চাই নৈতিকতার শপথ
যৌন নিপীড়নের শাস্তি বাধ্যতামূলক ছুটি!

কন্যা সন্তানের জন্মদান আমাদের সমাজের কেউ কেউ এখনো তেমনভাবে সাদরে গ্রহণ করতে পারছে না। কন্যাসন্তান হলে তার লালন-পালন এবং তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে বিয়ে-শাদী দেয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। সাধ থাকলেও অনেক বিয়ে-শাদীতে অকাতরে অর্থ খরচ করার সামর্থ্য থাকে না। আমাদের সমাজে যাদের অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে, তারা হয়তো অকাতরে তার কন্যা সন্তানের বিয়ে-শাদীতে প্রচুর খরচ করতে পারেন। অথচ সীমিত আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব নয়। কন্যাসন্তান নিয়ে অভিভাবকদের নতুন করে দুশ্চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আর সেটি হলো ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক অনাচার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ বিভাগের ছাত্রীদের তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য করেন। একই বিভাগের একজন ছাত্রী তার শিক্ষকের কাছে নানাদিক থেকে দায়বদ্ধ থাকে। এদিক-ওদিক হলে বিভিন্ন পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। লেখাপড়া কিংবা আর্থিকভাবে সহায়তা করার নামেও ছাত্রীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কৌশল শিক্ষকরা অবলম্বন করে থাকেন। শিক্ষকদের অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেও লজ্জা বোধ হয়। অথচ তাদের কুকৃর্তি মানুষ আর কত দিন মুখ বুজে সহ্য করবে। শিক্ষকের অনাচারের বিচারের দাবি জানাতে হবে, এমন শিক্ষক তো সমাজ চায় না। এমনটি চায় না শিক্ষাঙ্গনের বাসিন্দাদের মতো অসহায় অভিভাবকরা।

শিক্ষকরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তির আসনে থাকবেন। তারা ছাত্রীদের পিতৃতুল্য। অথচ কোনো কোনো শিক্ষকের ভূমিকা যদি লম্পটের মতো হয়, তাহলে শেষ আশ্রয় কোথায়, সেটি তো অজানা। আমাদের কন্যা সন্তানরা উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে জ্ঞান অর্জন করবে- সেটাই তো সবার কাম্য। তারা পুরুষের পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে অংশ নেবে- এটাই তো আমাদের চিন্তাচেতনা। অথচ একজন ছাত্রীর মনের মধ্যে যদি সব সময় শিক্ষক ভীতি কাজ করে, তাহলে তার শিক্ষাজীবনের প্রসারতা সংকুচিত হবে। ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদকে ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল মনসুরের কাছে পাঠানো চিঠিতে সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে অধ্যাপক নাদিরকে ৩ মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠনসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়। তাহলে ছুটি পাঠানোর মধ্য দিয়ে কি তার শাস্তি হয়ে যাবে এ প্রশ্ন অনেকের। ৩ মাস পর এসব অভিযোগের কথা মানুষ ভুলে যাবে। ওই শিক্ষক প্রভাব ঘাটিয়ে হয়তো সব কিছু তছনছ করে দেবেন। শিক্ষকরাই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করলে সেটির নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সে কারণে তৃতীয় কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে এই অভিযোগ খতিয়ে দেখা দরকার কি-না, সেটা ভাবতে হবে। শিক্ষকের কাছে যদি একজন ছাত্রীর ইজ্জত আব্রু নিরাপদ না থাকে, তাহলেও তো কোনো অভিভাবক তার কন্যাকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করবেন না। নারীরা শিক্ষা দীক্ষা ও জ্ঞান অর্জনে পিছিয়ে পড়বে। দেশ পিছিয়ে যাবে। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। এই নারী শিক্ষার্থী প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর নাদির জুনাইদের বিচারের আগ পর্যন্ত সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মানববন্ধন করেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গত সোমবার অধ্যাপক নাদিরের অফিসকক্ষ ও ক্লাসরুমে তালা দেন তারা। পরে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই অধ্যাপক নাদিরকে ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দিলো প্রশাসন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী এগুলো নৈতিক স্খলন ও অসদাচরণজনিত অপরাধ। এসব ঘটনার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বেশ কিছু ফটোগ্রাফ, চ্যাটবক্সের স্ক্রিনশট এবং অডিও ক্লিপের মাধ্যমে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটি, সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি অল্পসময়ের ব্যাবধানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধেও ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের আগে পবিত্র গ্রন্থ হাতে নিয়ে নৈতিকতার শপথগ্রহণ করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে। শুধু বাধ্যতামূলক ছুটি কিংবা চাকরি থেকে বহিষ্কার করার মধ্যদিয়ে শাস্তি দেয়া হলে কি এই সমস্যার সমাধান হবে? তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই শিক্ষকের নাগরিকত্ব বাতিল এবং যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে নিষিদ্ধ করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষক যৌন নিপীড়ন মুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হলে অভিভাবকদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত