ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই সনদ

রপ্তানি বাড়িয়ে অর্থনীতি হতে পারে সমৃদ্ধ
ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই সনদ

যে কোনো দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন বা জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। জিআই স্বীকৃতি ওই সামগ্রীর নির্দিষ্ট গুণগত মানদ- বা নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করে। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। এই অধিদপ্তরের মূল কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে মেধাসম্পদ সুরক্ষায় নতুন নতুন উদ্ভাবনের পেটেন্ট, ডিজাইন স্বত্ব মঞ্জুর করা, পণ্য ও সেবার ট্রেডমার্ক এবং জিআই নিবন্ধন করা। বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা ২৮টি। সবশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আরো চারটি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়ে জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। পণ্য চারটি হলো- রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজারের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর ও মুক্তাগাছার মন্ডা। এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে জিআই পণ্য হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা এবং নরসিংদীর অমৃত সাগরকলার জিআই সনদের জার্নাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। দেশে প্রথম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি শাড়ি, ২০১৬ সালে। এরপর বাংলাদেশের ইলিশ মাছসহ আরও অনেক পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে। এছাড়া জিআই সনদের জন্য আবেদন জমা রয়েছে আরও কয়েকটি পণ্যের। মসলিনের পর বাংলাদেশের জামদানি এরইমধ্যে বৈশ্বিক ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। অথনৈতিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে জিআই সনদ উৎপাদকদের পণ্যের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়। এতে অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে তাদের পণ্য আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে তাদের এই পণ্যের আলাদা খ্যাতি তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপদনকারীরা পণ্যের জন্য ভালো দাম পান। ট্রেডমার্কের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো ট্রেডমার্ক কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিতে পারেন অথচ জিআই সনদ একটি দেশ প্যাটেন্ট করতে পারে। যা সেই দেশের পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে পরিচিতি পায়। এতে স্থানীয় উৎপাদকরা ভালো দাম পাবেন। মোট কথা জিআই পণ্য কোনও দেশ আমদানি করতে চাইলে তাহলে উৎপাদনকারী দেশকে একটি নির্ধারিত হারে রয়েলটি পরিশোধ করতে হবে। যা জিআই সনদ না পাওয়া পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়াও জিআই পণ্য প্রক্রিয়ায় একটি দেশ তার দেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যকে নিবন্ধন করে। এর ফলে ওই পণ্যটি যেমন ব্র্যান্ডিং পায়, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে সেই পণ্যের মূল্যও বাড়ে। কিছু পণ্যের জিআই স্বত্ব নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিমতের হতে পারে। এসব পণ্যের মধ্যে অন্যতম সুন্দরবনের মধু। সুন্দরবনের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে অবস্থিত। সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বত্ব নিয়ে আবেদন করা রয়েছে। জিআই সনদ পাওয়ার জন্য যশোরের খেজুর গুড়, নরসিংদীর লটকন, জামালপুরের নকশিকাঁথা, মধুপুরের আনারস, রাজশাহীর মিষ্টি পান, শেরপুরের ছানার পায়েশ, ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ এবং নওগাঁর নাগ ফজলি আম। এছাড়া দিনাজপুরের লিচু রয়েছে আবেদনের প্রক্রিয়ায়। বাংলাদেশের যে সব পণ্য জিআই সনদ পাওয়ার তালিকায় রয়েছে সেগুলোর কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে জিআই স্বত্বের প্রক্রিয়াধীন আবেদনগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে এক বা একাধিক পণ্য বা বস্তু খুঁজে বের করে আবেদন করার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করা হয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির পর এগুলোকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে। জিআই স্বত্ব সনদ প্রাপ্তির আবেদন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যারা আবেদন করেন তাদের যথাযথভাবে ডকুমেন্টেশনগুলো সম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকের ঘাটতি থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যারা উৎপাদনকারী বা যে এলাকায় যে পণ্য উৎপাদন হয় সেখানকার সংশ্লিষ্ট অনেকেই এসব ডকুমেন্টেশনের নিয়মগুলো জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের এসব বিষয়ে সাহায্য করতে হয়। এখন পর্যন্ত আমাদের রফতানি খাতের খুব ছোট অংশ আসে জিআই থেকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি শিল্পনির্ভর হবে তখন মেধাস্বত্বের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। যত বেশি পণ্য জি আই সুবিধা পাবে আমাদের অর্থনীতি তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। কেননা জিআই পণ্য উৎপাদনে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। এ ছাড়া বিদেশের মাটিতে এসব পণ্যের ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ায় বিদেশিরা আমাদের জিআই পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। ফলে রপ্তানির একটা চমৎকার সুযোগ তৈরি হয়। সে কারণে আরো যে সব পণ্য জিআই সনদ পাওয়ার উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হবে সেগুলো খুঁজে বের করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিতে হবে। এসব আবেদন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যতদূর সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে পণ্যটি জিআই সনদ পাওয়ার উপযোগী হলে তাকে সেই সনদ দেয়া উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত