ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নির্যাতন

সংশোধন হতে গিয়ে মৃত্যু কাম্য নয়
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নির্যাতন

‘বাবা আমি জীবনেও আর মারামারি ও খারাপ কাজ করব না। তুমি আমারে এখান থেকে নিয়া যাও। ওরা আমাকে দিয়ে বাথরুম ও থালাবাসন ধোয়ায়। না ধুইলে অনেক মারধর করে।’ আট দিন আগে স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমকে সঙ্গে নিয়ে রফিক আহমেদ গাজীপুরের টঙ্গীর ?শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গেলে এমন আকুতি জানায় তাদের আদরের সন্তান। বাবা-মাকে দেখে কান্না করতে করতে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায় কিশোর মারুফ আহমেদ। অথচ তার আর জীবিত বাড়ি ফেরা হলো না। লাশ হয়ে ফিরতে হলো বাবা-মায়ের কাছে। গত বুধবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় এই কিশোর। এর আগে গত শনিবার অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে টঙ্গীর ?শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা-মা। মারুফ কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার অষ্টগ্রাম গ্রামের রফিক আহমেদের ছেলে। বাবার অভিযোগ, শিশু কেন্দ্রের ভেতরে নির্যাতনের কারণে ছেলের মৃত্যু হয়েছে। মারধরে অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন শিশু কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। পরে বাবাকে খবর দেওয়া হয়। মারুফ বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর খিলক্ষেত দর্জিবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। গত ২৭ জানুয়ারি খিলক্ষেত এলাকায় এক ঝালমুড়ি বিক্রেতার সঙ্গে কয়েকজন ছেলের ঝগড়া হয়। সেখানে মারুফ দাঁড়িয়ে ছিল। ওই সময় খিলক্ষেত থানা পুলিশ দুই ছেলের সঙ্গে মারুফকে ধরে নিয়ে যায়। পরের দিন আদালতে চালান দেয়া হয়। মারুফের নামে ডাকাতির মামলা দেয় পুলিশ। ১৬ বছরের একটি কিশোরের বিরুদ্ধে পুলিশ কি করে ডাকাতির মামলা দেয় সেটাও বোধগম্য নয়। আদালত থেকে তাকে টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সংশোধিত হতে। অথচ তার শরীর, হাতের কনুই এবং পিঠের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরিবারের অভিযোগ ভয়াবহ নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশও বলছেন, ‘ওই কিশোরের ডান চোখের পাশে কালো দাগ ছিল। ডান ও বাঁ হাতের কনুই থেঁতলানো ছিল, দুই পায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ছিল। এসব অভিযোগের সত্যতা মিলবে ময়নাতদন্তের পর। টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক দেলোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকর্মীরা ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য গণমাধ্যমে আসেনি। গাজীপুর, টঙ্গী ও যশোরে তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এ সব কেন্দ্রে জীবনমান, খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নামে উন্নয়ন কেন্দ্র হলেও পরিবেশ জেলখানার চেয়ে বাজে অবস্থা। সেখানেও রয়েছে ‘বড় ভাই’ কালচার। যার জাঁতাকলে পরে কিশোরদের জীবন দুর্বিষহ। ১৯৭৮ সালে গাজীপুরের টঙ্গীতে এবং ১৯৯৫ সালে যশোরের পুলেরহাটে ছেলে শিশুদের জন্য এবং ২০০৩ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে (মেয়েদের জন্য) উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত তিনটি কেন্দ্র আসনের চেয়ে বেশি নিবাসী নিয়ে চলছে। কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমিত বাজেট, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত জনবল, অনুন্নত সংশোধন প্রক্রিয়া, পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। কেন্দ্রে থাকা একটু বেশি বয়সিদের মধ্য থেকে হাউস ক্যাপ্টেন ঠিক করে দেন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক। ক্যাপ্টেন বা কেন্দ্রের ভাষায় এই ‘বড় ভাই’ আবার তার পছন্দের নিবাসীদের নিয়ে দল গঠন করে। জুনিয়র ব্যাচ, সিনিয়র ব্যাচ বিভিন্ন নামের দলগুলো বিভিন্ন ফ্লোরে ও রুমে রাজত্ব করে।

কেন্দ্রে নতুন সদস্য গেলে তাকে ‘পাবলিক’ বলে ডাকা হয়। বড় ভাইয়ের নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নানা রকমের শাস্তি। বড় ভাই ও ভাইয়ের অনুগত সদস্যদের থাকার জায়গা উন্নত। বড় ভাই চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। হাউস ক্যাপ্টেন সবার প্লেট থেকে মুরগি ও মাছের বড় পিস তুলে নিয়ে যায়। সাবানসহ অন্যান্য বরাদ্দ করা জিনিসের বেলায়ও একই নিয়ম। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নানা অনিয়মের ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন তৎপরতা এর আগেও নেওয়া হয়েছে। তবে কার্যত কোনো সুফল মিলেনি। টঙ্গী কেন্দ্রের শিশুরা সংবাদের শিরোনাম হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। খাবার না দেওয়া ও নির্যাতনের প্রতিবাদে কেন্দ্রের পাঁচ কিশোর নিজেদের শরীর কেটে ক্ষতবিক্ষত করে। ক্ষতস্থানে সেলাই দিতে হয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি ঘটনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন, দায়ী ব্যক্তিদের সাময়িক বরখাস্তসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে এ ধরনের অঘটনা থামেনি। রফিকের বিষয়টি নিয়ে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় কি পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। কেন না, সংশোধন কেন্দ্রে গিয়ে কিশোররা সংশোধন হবে। তারা অপরাধ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করবে, সেটাই কাম্য। অথচ তারা লাশ হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাবে, সেই প্রতাশা কেউ করে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত