ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বইমেলা প্রাণের ধারক

অলোক আচার্য
বইমেলা প্রাণের ধারক

ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। একটি বিশেষ সময়ের স্মৃতির ধারক-বাহক। আমাদের মনের সঞ্চারণায় জেগে ওঠে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই ফেব্রুয়ারিতেই আয়োজন করা হয় দেশের সবচেয়ে বড় বইমেলার। দেশের বিভিন্ন স্থানে বইমেলা হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা পরিসরে বৃহৎ। সেই ধারাবাহিকতায় বছর ঘুরে আবার এসেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ক্ষণ।

এ সময় ফেব্রুয়ারি মানেই রাজধানী ঢাকায় বইয়ের উৎসব। চারিদিকে নতুন বইয়ের গন্ধ ভাসে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে এটি আর এখন কেবল একটি মেলা নয়। অনেক বইপ্রেমী সারা বছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এবং এ মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন।

জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এরপর ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করেছে। যতদিন যাচ্ছে ততই জমে উঠছে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের এক মহামিলন মেলায় রূপ নেয় সবার প্রিয় এ বইমেলা। এ শুধু বইমেলা নয়, এ এক প্রাণের মেলা। আত্মার সঙ্গে আত্মার যেমন সম্পর্ক, তেমনি বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক।

সাহিত্য হলো দেশের মননশীলতার প্রাণ। আর সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। লেখক ও পাঠকের মিলনমেলায় পরিণত হবে বইমেলা। বইপ্রেমীরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য। নতুন বই নতুন লেখক কবির মিলনস্থল এই বইমেলা। পুরাতন পাঠকদের সঙ্গে যোগ হয় নতুন প্রজন্মের বই পড়ুয়া পাঠকরা।

এই পরিবেশ দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। বইমেলার কেন্দ্রবিন্দু হলো বই। যুগ যুগ ধরে যা জ্ঞান বিতরণের মহা দায়িত্ব পালন করে আসছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে বদল হয়ে বইয়ের ধরন। কিন্তু বদলায়নি বইয়ের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। নতুন-পুরাতন লেখক, কবি ও প্রকাশক মেলার দর্শক সবাই উপস্থিত হয়। বইমেলায় আসা থেকে শুরু করে বই বিক্রি করাই শেষ কথা নয় অথবা মেলার স্বার্থকতা নয়। মিলনমেলায় সবাই একত্রিত হওয়াটাও উদ্দেশ্য। নতুন বই বইয়ের গন্ধ এসব যেন আমাদের আত্মার সঙ্গে মিশে যায়।

আজও আত্মার সঙ্গে মিশেই রয়েছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে মানুষের আত্মার খোরাক যোগাতে থাকে। তৈরি হয়েছে আলাদা আলাদা পাঠক শ্রেণি। গল্পের বা উপন্যাসের বই পড়তে পড়তে কত বই পড়ুুয়াদের রাত ভোর হয়ে যায়। এসব পড়ুয়া বই প্রেমীদের হাত ধরে তৈরি হয় বইয়ের সংগ্রহশালা। সেসব সংগ্রহশালায় থরে থরে শোভা পেতে থাকে পাঠকের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। ১৯৫২ সালের এ মাসেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। সে স্মৃতি বাঙালি জাতির কাছে আজো চির অম্লান। ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমি মাসব্যাপী আয়োজন করে বইমেলার। বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। বইমেলা এলেই পাঠক-লেখক আর প্রকাশকদের নিয়ে তৈরি হয় অন্যরকম এক অনুভূতির জায়গা। সরগরম থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বইপ্রেমীরা প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য ছুটে আসেন মেলায়। এ এক আত্মীক বন্ধন। এই বন্ধন গড়ে ওঠে বইমেলা কেন্দ্র করে।

আমাদের দেশের আজকাল বই নিয়ে চিত্রটা বেশ কমন। নতুন বই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। নতুন লেখক বইমেলা কেন্দ্রীক। এমনকি বই কেনাটাও সেই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। সারাবছর তেমন কোনো নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বইমেলা এলেই বই প্রকাশের হিড়িক লেগে যায়। তা হোক। মেলাতে এমনটিই হবে। তবে বই নিয়ে এমন আগ্রহ যদি সারাবছর থাকত, তাহলে বেশ ভালো হতো। অথচ বইয়ের সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। লেখক, প্রকাশক, ছাপাখানার কর্মীরা সারাবছর এক প্রকার নীরব থাকেন। তাদের তেমন কোনো ব্যস্ততা থাকে না। সব ব্যস্ততা তোলা থাকে বইমেলার জন্য। ফলে বইয়ের চাহিদা একটা নির্দিষ্ট সময়ে থাকবে সেটিই খুব স্বাভাবিক। বই পড়ার অভ্যাস এখন কমেছে এটি সত্যি। তবে এতটা কমেনি। কিন্তু বই প্রকাশের গতি শুধু বইমেলা কেন্দ্রীক হওয়ার এখনো টিকে থাকা পাঠকরা তাই সারাবছর অভুক্ত থাকে। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে এমন কোনো লেখক পাঠক মহলে সাড়া ফেলতে পারেননি যার বইয়ের টানে পাঠকমহল ছুটে আসে। যার বইয়ের খোঁজ সারা বছর নেয় পাঠকরা। হূমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ার পর সেই অভাবটা আরো বেশি টের পাচ্ছে মেলা প্রাঙ্গণ। ঘুরে ফিরে সেইসব লেখক কবিদের বই-ই বইমেলাজুড়ে। তবু বইমেলা এক অনন্য অনুভূতির জন্ম দেয়।

বই পুরাতন হয় না। শুধু পাঠক পরিবর্তন হলে বইটি আবার নতুন স্বাদ উপহার দিতে পারে। এই ডিজিটাল স্ক্রিনের যুগে বইয়ের যখন অস্তিত্ব নিয়েই সংকট তখন বইমেলা সত্যি বইয়ের পাঠকদের জীবনে প্রশান্তি এনে দেয়। প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের বিনিয়োগের সিংহ ভাগই বইমেলার জন্য রেখে দেয়। সারা বছর কোনো মতে টিকে থাকা এই প্রকাশনা শিল্প যেন প্রাণ ফিরে পায় বইমেলা এলে। মুদ্রণশিল্প, ডিজাইনিং সব শাখার কর্মীদের জন্য বেড়ে যায় ব্যস্ততা। এবারো সেই ব্যস্ততা চলছে। শুধু মনের গভীরে শঙ্কা বিরাজ করছে। বইমেলায় পাঠকদের প্রাণ সঞ্চার করে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে বইমেলার আয়তন বেড়েছে অনেকখানি। বেড়েছে প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা। এসেছে বহু নতুন লেখক, কবি ও গবেষক। বইমেলায় একদিকে যেমন প্রচুর বই আসছে সেই সঙ্গে সেসব বই বিক্রির সংখ্যা কম। হঠাৎ করে আসা লেখক-কবির অনেককেই পরবর্তীতে সাহিত্য চর্চায় দেখা যায় না।

তবু নতুন লেখক আসছে, বহু প্রকাশনী গড়ে উঠছে এবং এর প্রসার লাভ হচ্ছে এটিই প্রশান্তির। অনেক প্রকাশনী আছে যারা বই বের করার জন্য মুখিয়ে থাকে। বই বিক্রি না হলে তো পুরোটা লোকসান। লেখক নিজের টাকা দিয়ে বই বের করেন। অনেক লেখক কবি প্রতি বছর বই বের করেন। কিন্তু তারা আদৌ কোনো পাঠকশ্রেণি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ। হাতে গোনা কয়েকজন লেখক আজ পাঠক টানতে পারছেন। তাই সাহিত্যের মান রক্ষা করা জরুরি। যারা লেখালেখির জগতে নতুন, তাদের একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন সাহিত্য বিষয়টি নিয়মিত চর্চা করে।

হুট করে বই প্রকাশ করার চেয়ে সময় নিয়ে লেখালেখিতে আরো মজবুত ভিত্তি করে তারপর প্রকাশে যাওয়া উচিত। সাহিত্য চর্চায় ধৈর্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিতচর্চা ছাড়া যেমন কোনো কাজই সফলতা অর্জন করা সম্ভব না, তেমনি সম্ভব না সাহিত্যেও। বইমেলা সব বিভেদ দূর করে বাঙালির প্রাণের সঞ্চার করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। বইমেলা বাঙালির ভাষা চর্চারও জায়গা। বই বেশি বেশি পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দেখা যায় হাতে হাতে পুরস্কার হিসেবে প্লেট তুলে দিতে। যদি তাদের হাতে প্লেটের বদলে একটি করে বই তুলে দেওয়া যায় তাহলে বইয়ের প্রচার এবং বিক্রি ও প্রসার যেমন বাড়বে, সেভাবেই তাদের শতকরা কয়েকজনও যদি সেই বই কৌতূহলে পড়ে, তখন তাদেরও বই পড়ার আগ্রহ জন্মাতে পারে। এভাবে দেশে একটি বই পড়া প্রজন্ম গড়ে উঠবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত