যে জাতির বই-পুস্তক সংখ্যা যত বেশি, তার মেধাগত সমৃদ্ধিও তত বেশি। তাছাড়া শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এমনকি অক্ষরজ্ঞানহীন এমন কোনো মানুষ নেই, যার সঙ্গে বইয়ের আত্মার নিবিড় সম্পর্ক নেই। যারা বই থেকে নিজেদের মন-মানসিকতা-গঠন এবং আত্মার খাদ্যখোরাক খুঁজে নেয়- তাদের কাছে বই যেমন মেধা-বিকাশ এবং মানসিক পরিতৃপ্তির আশ্রয়স্থল; তেমনি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও বইয়ের বুকে গাঁথা পৃষ্ঠার অক্ষর বা ছবিতে হাত বুলিয়ে পরাণের গহিন থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা না করে নিজের অক্ষমতায় আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীজুড়ে বিচিত্র সব বইমেলার আয়োজন চলে আসছে। ১৮০২ সালে ম্যাথু কেরির উদ্যোগে প্রথম বইমেলার আসর বসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। ১৮৭৫ সালে প্রায় ১০০ জন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করে বৃহৎ এক বইমেলার। ওই মেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার বই। ১৯৪৯ সালে শুরু হয় জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের বৃহৎ বইমেলা, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপ নেয়। সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার স্মরণীয় শুভযাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রকাশনার দিক থেকে লন্ডন বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার অন্যতম। তবে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার মতো বড় না হলেও এ মেলার গুরুত্ব অনেক। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বইমেলা ১৯৮৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। বর্তমানে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম রোববার পর্যন্ত ১২ দিনব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়া বর্তমানে লন্ডন, কানাডাসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই আন্তর্জাতিকমানের বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো। শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। জার্মানিতে বইয়ের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য মেলা হলো এটি। প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আয়োজন করা হয়ে থাকে এই মেলা। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করে। সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বইয়ের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরিতে এই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। গেস্ট অব অনার হিসেবে প্রতিবছর কোনো একটি দেশকে বেছে নেওয়া হয়। সে দেশের সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করা হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। অতিথি দেশের জন্য বিশেষ প্রদর্শনী হলের ব্যবস্থাও করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এই মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি। আর ১৯৬৪ সাল থেকে এই মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। এই মেলার মেলার সময়কাল পাঁচ দিন। মেলার আয়োজক জার্মান পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিবছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক ও সাংবাদিকের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা।
প্রকাশনার দিক থেকে লন্ডন বইমেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলার অন্যতম। তবে আয়তনে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মতো বড় না হলেও এই মেলার গুরুত্ব অনেক। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা এটি। সাধারণত বছরের মার্চ মাসে এই মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। সব মিলিয়ে মেলার মেয়াদ ১২ দিন। তবে মেলা আয়োজনের প্রথম দিকে এর মেয়াদ ছিল সাত দিন। জনপ্রিয়তার কারণে পরবর্তী সময়ে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
তবে কখনো কখনো অক্টোবরেও মেলার তারিখ পরিবর্তন হয়, সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মেলার স্থানও। যেমন ২০০৬ সালে মেলাটি হয়েছিল লন্ডনের অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে আবার পরের বছর হয় ডকল্যান্ডের আর্ল কোট এক্সিবিশন সেন্টারে। গত বছর এই মেলায় বিশ্বের প্রায় ১০০-এরও বেশি দেশ থেকে ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, সংবাদমাধ্যম কর্মী অংশ নিয়েছিল। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, অন্য প্রকাশক থেকে বইয়ের স্বত্ব অথবা বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনাবেচার জন্য প্রকাশকরা এই মেলায় অংশ নেয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার সঙ্গে এই মেলার বড় পার্থক্য হলো- এটি প্রকৃত অর্থে প্রকাশকদের মেলা। এখানে সাধারণ পাঠকের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। এখানে ভিড় করেন বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা।
২০০৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে আয়োজিত হচ্ছে ব্রুকলিন বইমেলা। অন্যান্য বইমেলার মতো এখানেও বড়দের পাঠের দিকেই প্রধানত নজর দেওয়া হয়। তবে বাড়তি আয়োজনও থাকে শিশুদের জন্য। শিশুদের বইয়ের আয়োজনসহ থাকে তাদের জন্য নানা কর্মপ্রক্রিয়া। ব্রুকলিন বইমেলায় চলে বড়দের পাঠচক্র, সাহিত্য আলোচনা, বই বিকিকিনি এবং লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকদের চুক্তি স্বাক্ষর।
ওয়েলসের ব্রেকনকশায়ার ডিস্ট্রিক্টের ছোট বাজার শহর হে-অন-ওয়ে; সেটারই ছোট নাম হলো ‘হে’। হেকে বলা হয়ে থাকে বইয়ের শহর। আসলে এটা ওয়েলসের জাতীয় বইয়ের শহর। শহরটি ওয়ে নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীরে অবস্থিত। হংকং বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। প্রতিবছর মধ্য জুলাইয়ে এই মেলা শুরু হয়। হংকং কনভেনশন অ্যান্ড এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত মেলার উদ্দেশ্য হংকংয়ের জনগণের জন্য কম দামে দেশি বা বিদেশি বই পৌঁছে দেওয়া। এই মেলা মূলত আন্তর্জাতিক বই ব্যবসাকে উৎসাহিত করে। ১০ দিনব্যাপী চলা এই আসরে প্রায় ৮০ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। হংকং বইমেলার প্রথম আসর বসে ১৯৯০ সালে। হংকংয়ে বছরের একটি প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে এই বইমেলা। প্রতিবছর দর্শনার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
মে মাসের মাঝামাঝি ইতালির তুরিনে অনুষ্ঠিত হয় তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা। এটাই ইতালির সবচেয়ে বড় বইয়ের বাণিজ্য মেলা। এই বইমেলা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। সে বছরের ১৮ মে উদ্বোধন করা হয় মেলা। উদ্বোধন করেন নোবেলজয়ী রুশ কবি যোসেফ ব্রডস্কি। ব্যবসায়ী গিদো আকোনেরো এবং বই বিক্রেতা আনজেলো পেজানা বইমেলার নাম দেন মেলোন দেল লিব্রো। পরবর্তীতে নাম রাখা হয় তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ যাবত বেশ কয়েকবার নাম বদল করা হয়েছে এই মেলার। ২০২৩ সালে এখানে ১ হাজার ৪০০ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সে বছর দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজারের ওপরে।
চীনের সাংহাইতে অনুষ্ঠিত হয় সংহাই সাহিত্য উৎসব। স্বল্প পরিসরে হলেও আন্তর্জাতিক আবহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই উৎসব। যেমন নবীনতম বুকারজয়ী লেখক এলিনর ক্যাটন থেকে শুরু করে বেস্ট সেলিং এমি ট্যান পর্যন্ত ঘুরে গেছেন এই উৎসব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আগস্টে চলে দেশটির জাতীয় বইমেলা। এটি আয়োজন করে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস। এই বইমেলায় সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে প্রেসিডেন্টকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। যেমন- সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এই বইমেলার বিশেষ সম্মানিত অতিথির চেয়ারে বসেন। এই মেলায় আলোচনা সভাসহ চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও থাকে।
২৫টি দেশের প্রায় ১৬ হাজার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে ১৯৯৩ সাল থেকে জাপানে চলছে টোকিও আন্তর্জাতিক বইমেলা। টোকিওর বিগ সাইট কনভেন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই বইমেলা। বইয়ের বাণিজ্যিক কাটতি এবং প্রচার বাড়ানোই মূলত এই মেলার উদ্দেশ্য।
বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা চলে আসছে ১৯৮৬ সাল থেকে। প্রকাশনা শিল্পে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এই বইমেলা।
ইতালির বোলোগনাতে প্রতিবছর মার্চ কিংবা এপ্রিলে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় বোলোগনা শিশু সাহিত্যের বইমেলা। ১৯৬৩ সাল থেকে চলে আসছে এই মেলা। শিশুদের বইয়ের লেখক প্রকাশকসহ আরো অনেক পেশাদার লোকজনের আগমন ঘটে এই মেলায়। অনুবাদের জন্য এবং বই থেকে অন্য মাধ্যমের শিল্প তৈরির জন্য এখানে বইয়ের স্বত্ব কেনাবেচা হয়। শিশুদের বই থেকে যারা শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তারা মূলত এখান থেকেই বইয়ের স্বত্ব কিনে থাকেন।
এটি আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বইমেলা। এর আয়োজক জেনারেল মিসরীয় বুক অর্গানাইজেশন। এই বইমেলাটি শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। কায়রোর ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার গ্রাউন্ডসে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য শিশু সাহিত্যে আগ্রহী লেখক ও প্রকাশকদের ফোরাম তৈরি। প্রতিবছর এই মেলায় প্রায় ৩ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী আসেন।
তেহরানে বিগত ২৪ বছর ধরে আন্তর্জাতিক এই বইমেলার আয়োজন হয়ে আসছে। প্রতিবছর মে মাসের ৪ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। লেখক-পাঠক আর গ্রন্থানুরাগীদের ভিড়ে বইমেলা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। কয়েক মিলিয়ন ইরানি পাঠক বার্ষিক এ বইমেলায় এসে বই কেনাকাটা করেন। এই মেলা ইসলামের ইতিহাস, ইরান ও বিশ্বের ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস এবং পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ সংক্রান্ত বইয়ের জন্য বিখ্যাত।
২০০৭ সালে আবুধাবির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কর্তৃপক্ষ এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে ‘কিতাব’ নামের একটি সংগঠন দাঁড় করায়। এই কিতাবই এখন আয়োজন করছে আবুধাবি বইমেলা। মার্চের ১৫ থেকে ২০ তারিখে এই মেলা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় বইমেলা এটি।
হাজার বাধা পেরিয়ে কলকাতা বইমেলা, ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হওয়া কলকাতা বইমেলা আজও সমানভাবে বিরাজিত। রূপে কিছুটা পরিবর্তন হলেও চরিত্র রয়েছে একই। গোটা বিশ্বকে কয়েকদিনের জন্য মিলিত করে কলকাতা বইমেলা। কিন্তু বইমেলা শুরুর ইতিহাস আজও অনেকের অজানা। সালটা ১৯৭৪। কলকাতার কিছু প্রকাশনী সংস্থার যুবক কর্ণধাররা আগামী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন কলকাতা কফি হাউসে। তখন তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনের মাথায় আসে একটি পরিকল্পনা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আদলে কলকাতার বইপ্রেমীদের জন্যও কিছু একটা ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? যেখান থেকে ভালো ভালো বেশ কিছু বই থেকে নিজেদের পছন্দমতো বই কিনতে পারবেন পাঠকরা। প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু যুবক প্রকাশকদের সেই পরিকল্পনাকে কোনো আমল দিতে চাননি সেখানে উপস্থিত প্রবীণ প্রকাশকরা। তাদের যুক্তি ছিল, বই পণ্য না-কি যে বিক্রি হবে? তাই বই বিক্রিটিক্রির মেলা নৈব নৈব চ।
১৯৭৫ সাল। যুবক প্রকাশকরা অতি সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তৈরি করলেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল সুশীল মুখোপাধ্যায়কে। প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়জয়ন্ত মানাকতালাকে। না তারপর আর দেরি করেনি গিল্ড। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হয় কলকাতা বইমেলা। অংশগ্রহণ করে ৩৪টি প্রকাশনী সংস্থা। স্টলের সংখ্যা ছিল ৫৬। ওই বছর ৫ মার্চ থেকে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে শুরু হয়েছিল বইমেলা। তৎকালীন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উদ্বোধক। প্রবেশ মূল্য ধার্য করা হয়েছিল ৫০ পয়সা। সেই বছর থেকে কলকাতা বইমেলাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে শুরু করে ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার।
১৯৭৯ সাল। বাংলার প্রকাশনা জগৎ ২০০ বছরে পদার্পণ করল। সেই উপলক্ষ্যে গিল্ডের পাশাপাশি আনন্দবাজার পত্রিকাও একটি বই প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করে। যেটি ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রসদনের সামনের একটি মাঠে।
১৯৮৩ সাল। সাত বছরে কলকাতা বইমেলা ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আসতে শুরু করেছে বিদেশি পাঠকও। সেই বছর কলকাতা বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশেনের সেক্রেটারি কউটকউমউ। আর ১৯৮২ সালে কলকাতা বইমেলা পরিদর্শন করে যান ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ডিরেক্টর পিটার উইথআর্স। সেই বছর থেকে কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তারপর থেকে ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশেনের ক্যালেন্ডারে উল্লেখ থাকে কলকাতা বইমেলার।
১৯৮৮। বিভিন্নভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে কলকাতা বইমেলা। কিন্তু সমস্যার সম্মুখীন হয় গিল্ড। মূলত জায়গার সমস্যা। স্টল বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরোনো জায়গায় মেলা করা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। বইমেলাকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় পার্ক স্ট্রিট ও আউটট্রাম রোডের সংলগ্ন একটি অব্যবহৃত মাঠে।
১৯৯১ সাল থেকে কলকাতা বইমেলায় শুরু করে বিভিন্ন থিম। মূলত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে অনুসরণ করেই এ ধরনের থিমের সূচনা হয়। প্রথমে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলোকে থিম হিসেবে তুলে ধরা হয়। কলকাতা বইমেলার প্রথম থিম রাজ্য ছিল অসম। তারপর ওড়িশা, বিহার প্রভৃতি রাজ্যও থিম হিসেবে উঠে আসে বইমেলায়। থিম রাজ্যের সাহিত্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরাই উদ্দেশ্য ছিল গিল্ডের।
এরপর ১৯৯৭ সাল থেকে কলকাতা বইমেলার থিম হিসেবে উঠে আসে বিদেশ। প্রথম বিদেশি থিম ছিল ফ্রান্স। এছাড়াও সেই বছর থেকে বইমেলায় একটি বিশেষ স্থান থাকত যেখানে মেলা চলাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন নামি শিল্পীরা ছবি আঁকতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই বছর বইমেলাকে একটি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। বইমেলার ষষ্ঠ দিনে আগুন লেগে পুড়ে যায় মেলার বেশ কিছুটা অংশ। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহায়তায় বইমেলা ফের নতুন করে তৈরি করে শুরু করা হয়। ১৯৯৮ সালে চিরাচরিত ঘরানায় ফের শুরু হয় কলকাতা বইমেলা। সেবারের ফোকাল থিম ছিল ব্রিটেন।
২০০৮ সালে ফের বইমেলাকে কলকাতা হাইকোর্টের কোপে পড়তে হয়। হাইকোর্ট এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দেয়, পার্ক সার্কাস ময়দানে বইমেলা করা যাবে না। সেই বছর অন্য একটি দল ‘বইমেলা ২০০৮’ নামে সল্টলেক স্টেডিয়ামে অন্য একটি বইমেলার আয়োজন করে। আর সেই বছরই তৈরি হয় মিলন মেলা প্রাঙ্গণ। তারপর থেকে মিলন মেলাই কলকাতা বইমেলার স্থায়ী ঠিকানায় পরিণত হয়। ২০১০ সাল থেকে বইমেলায় শুরু হয় বিভিন্ন অফার। গিল্ডের তরফে ঘোষণা করা হয়, ২০০ টাকার বই কিনলে প্রবেশ মূল্য ফেরত দেওয়া হবে। আর তার পরের বছর থেকেই মেলায় প্রবেশ করতে আর কোনো অর্থ দিতে হবে না।
শুরুর পথটা বেশ কঠিন হলেও আজ নিজ গুণে বিশ্বের দরবারে কাছে নিজের জায়গা বেশ মজুবতই করে ফেলেছে কলকাতা বইমেলা।
বাংলা বইয়ের আরেকটি জম্পেশ বইমেলা হয়ে থাকে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায়। বহু বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বইমেলায় প্রতিবছরই বাংলাদেশি প্রকাশকরা অংশ নিয়ে থাকেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ এই মেলা প্রথম শুরু হয়েছিল; প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ বা মার্চ মাসে হয়ে থাকে। মেলাটি আগরতলা শিশু উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার অত্যন্ত সমাদৃত মেলা আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তকমেলার মতোই আগরতলা বইমেলা ত্রিপুরাতে খুব জনপ্রিয়।
১৯৮১ সালে আগরতলা বইমেলা সরকারিভাবে শুরু হলেও অনেকের মতে ১৯৬১ সালে বিলোনীয়া বিদ্যাপীঠ স্কুলের মাঠে প্রথম এই বইমেলার আয়োজন হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে সোনামুড়া এনসি ইনস্টিটিউশনে এই বইমেলার আয়োজন করা হয়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই বিক্রয়ের জন্য একটি স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তা ছাড়া ১৯৭৮ সালে বিশ্ব যুব উৎসব উপলক্ষ্যে কয়েকটি স্টলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ সরকারি সহায়তায় রবীন্দ্রশতবার্ষিকী ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলার উদ্বোধন করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজক ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং সেই মেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও ৮টি দেশের প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছিল সেই মেলায়। তবে বর্তমানে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা নামের যে আসরটি আয়োজিত হয়, সেটি শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। তখন থেকে ঢাকা বইমেলা নামে এই মেলা আয়োজিত হয় ১৪ বার। ২০০৮ সাল থেকে বর্ধিত পরিসরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা নামে এই মেলার আয়োজন চলছে। ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে মাসব্যাপী এই মেলা চলে। অন্যান্য দেশের মধ্য থেকে ইরান, ভারত, পাকিস্তান ও চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই মেলায় অংশগ্রহণ করে আসছে।
বছরের প্রতিটা ঋতুতে পাঠকের হাতে পৌঁছে যাক বই- এমন প্রত্যাশায় আয়োজন করা হয় হেমন্তের বইমেলা। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, শাহবাগ শাখা ও শাহবাগের বইপাড়া সংঘ যৌথভাবে এই মেলার আয়োজন করে আসছে। শাহবাগের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের মূল মিলনায়তনের সামনের উন্মুক্ত চত্বরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হেমন্তের যে কোনো এক বিকেলে ১০-১৫ দিনের জন্য বইয়ের জগতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন প্রকাশকরা। ২০১২ সালে এই মেলায় ৩৯টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছিল। মেলা কর্তৃপক্ষ আশা করে, বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো এই মেলাও একদিন লেখক-পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে। হেমন্তের একটি দিনও কাটবে না বই ছাড়া।
কাঁটাবনের কনকর্ড অ্যাম্পোরিয়ামের নিচে ২০০৯ সাল থেকে আয়োজিত হয়ে আসছে বর্ষার বইমেলা। ১ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর অর্ধশতাধিক প্রকাশনী মেলায় অংশ নেয়। শুধু বইমেলা নয়, মেলায় আগতদের জন্য বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে থাকে আয়োজক কমিটি। বাইরে মুষলধারা বৃষ্টি আর কনকর্ড অ্যাম্পোরিয়ামের নিচে বইয়ের সমাহার। এই বর্ষাও কাটুক বই আর সৃজনশীলতার সঙ্গে, তাই এই মেলা।
বন্দরনগর চট্টগ্রামও বইমেলার আয়োজন থেকে পিছিয়ে নেই। প্রতিবছর মার্চ মাসে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় চট্টগ্রাম বইমেলা। মুসলিম হল প্রাঙ্গণ বা ডিসি হিলে আয়োজন করা হয় এই মেলার।
বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা ফেব্রুয়ারি মাসে। এই ফেব্রুয়ারি রক্ষা করেছে আমাদের অস্তিত্ব, দিয়েছে আত্মপরিচয়। তাই, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির চেতনার উৎস; প্রেরণার শাশ্বত বাতিঘর। চেতনার পরশ বুলিয়ে ফেব্রুয়ারিতে উৎসবের আমেজ এনে দেয় বাংলা একাডেমির অমর একুশের গ্রন্থমেলা। এই মেলা এখন রূপ পেয়েছে বাঙালির প্রাণের মেলায়। প্রতিবছর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারিতে। চলে পুরো মাসজুড়ে। বইপ্রেমিকরা সারাবছর অপেক্ষা করেন এই মাসটির জন্য। লেখক-প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সবার নজর থাকে ফেব্রুয়ারিজুড়ে। আমাদের প্রকাশনা জগতে সারাবছরই বই প্রকাশ পায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বই প্রকাশ পায় একুশে বইমেলাকে ঘিরে। লেখকরাও এ মাসেই নিজেদের বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কারণ, একসঙ্গে এত পাঠকের সামনে নিজের বইটি তুলে দেওয়ার এমন সুযোগ আর দ্বিতীয়টি নেই। বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকে। তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের বইমেলার নাম দেওয়া হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৭২ সালে মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় তার প্রকাশনীর বই বিছিয়ে বসেন। ধীরে ধীরে এখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বইয়ের বিক্রিও। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি এই মেলাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। প্রতিবছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। ২০১৪ সাল থেকে মেলার স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েছে।
এছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তে আরো অনেক বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। সেগুলোর মধ্যে স্কটল্যান্ডের উইগটন বইমেলা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পিইএন ওয়ার্ল্ড ভয়েসেস ফেস্টিভল, যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ডস বাই দ্য ওয়াটার ফেস্টিভল, সিডনি রাইটার্স ফেস্টিভল বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য!