ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বেতার হচ্ছে সমাজ মানুষের মনের দর্পণ

মো. জিল্লুর রহমান
বেতার হচ্ছে সমাজ মানুষের মনের দর্পণ

১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে সবার মধ্যে বেতারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বেতারের মাধ্যমে তথ্য সুলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং বেতার সম্প্রচারকদের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সহায়তা ও পারস্পরিক মতামত ও তথ্য বিনিময় জোরদার করা। ইউনেস্কো প্রতি বছর সারা বিশ্বের সম্প্রচারক, সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বেতার দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জানা যায়, প্রথমবার ২০১০ সালে স্পেন রেডিও সংস্থার পক্ষ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন করার প্রস্তাব আসে। এরপর ২০১১ সালে এটি ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলো ঘোষণা করে এবং ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো প্রথম এই দিনটি বিশ্ব বেতার দিবস হিসাবে পালন করা শুরু করে। মূলত চারটি ধারায় রেডিও সম্প্রচার করে থাকে। যথা- পাবলিক সার্ভিস, আন্তর্জাতিক রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও। পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বেতার যেমন অনুষ্ঠান ও খবর সম্প্রচার করছে; তেমনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ভয়েস অব আমেরিকা, এনএইচকে, রেডিও তেহরান, রেডিও চায়না ও অন্যান্য বিদেশি মাধ্যমেও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারছি। আবার দেশে সাম্প্রতিক কালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সম্প্রচার করছে শহরভিত্তিক বেসরকারি এফএম রেডিও। সব মিলিয়ে বেতারের প্রচার দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিও’র সাফল্যও অনেক। আমাদের অনেকেরই ধারণা, ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার এই সময়ে রেডিও তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ, সময় যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচারণার ধরনও বদলে গেছে। এখনো বহু মানুষ বেতার শোনে। এখনও অনেক মানুষ বেতারের ওপর নির্ভর করে। সারাবিশ্বে বেতার এখনো অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে পৃথিবীর দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনো বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। আমরা হয়তো অনেকেই জানি, মার্কনি বেতারের আবিষ্কারক কিন্তু সাম্প্রতিক এক তথ্য জানা যায়, বাঙালি বিজ্ঞানি স্যার জগদীশচন্দ্র বসু মার্কনির আগেই বেতার আবিষ্কার করেছিলেন। এ তথ্যটি প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কনির নাতি পারসেশচে মার্কনি যিনি নিজে ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির একজন জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। কারণ, ১৯০১ সালে মার্কনি আটলান্টিকের ওপারে প্রথম বেতার সংকেত পাঠান এবং পাল্টা সংকেত গ্রহণ করেন কিন্তু এর আগেই ১৮৯৯ সালে মার্কনি বাংলার জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বসুই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি রেডিও এবং মাইক্রো ওয়েভসের অপটিক্সে নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯১৮ সালে লি দ্য ফরেস্ট নিউইয়র্কের হাইব্রিজ অঞ্চলে বিশ্বের প্রথম রেডিও স্টেশন শুরু করে। তবে পুলিশ এটিকে অবৈধ বলেছিল এবং এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পরে স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু, স্যার অলিভার লজ এবং আলেক্সান্ডার প্যাপোভ বেতারের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখেন। ১৯৩৬ সালে ভারতে অফিসিয়াল ‘ইম্পেরিয়াল রেডিও’ শুরু হয়েছিল যা স্বাধীনতার পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বেতারের যাত্রা শুরু ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আসলে বেতার এমন একটি গণমাধ্যম পৃথিবীতে যার ব্যাপ্তি অন্য সব গণমাধ্যম অপেক্ষা অনেক বেশি। এটি একাধারে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। দূরবর্তী জনসম্প্রদায় ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে (নিম্ন সাক্ষরতার হারবিশিষ্ট জনসম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী, তরুণ-তরুণী এবং দারিদ্র্যের শিকার ব্যক্তি) পৌঁছাতে বেতারের কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে এটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে জনবিতর্কে মানুষের অংশগ্রহণের একটি মঞ্চ। অধিকন্তু, জরুরি অবস্থাকালীন যোগাযোগ ও বিপর্যয়কালীন ত্রাণকর্মে বেতার একটি শক্তিশালী ও নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সমধর্মিতা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে, তাই বেতার সেবাগুলোও প্রযুক্তির নতুন নতুন রূপের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, মুঠোফোন, এফএম, কমিউনিটি ও ট্যাবলেটে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও বিশ্বের প্রায় শত কোটি লোকের কাছে এখনো বেতার সেবা সহজলভ্য নয়। সংবাদপত্র যদিও সবচেয়ে পুরোনো গণমাধ্যম কিন্তু এক সময় শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্রই প্রচার মাধ্যমের আভিজাত্যই ছিল বেতার। গল্প, উপন্যাস, নাটক এমনকি সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের দেখা যেত, তারা বেতারে গানের রেকর্ডিং করছেন। সেই গান শুনছেন দেশের হাজারও মানুষ ও অগুণিত শ্রোতা। কী যে সেই আকুলতা ও আগ্রহ! কখন শুরু হবে সেই প্রিয় নাটক কিংবা সিনেমার গান। বেতারে প্রোগ্রাম করা মানেই শিল্পীর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া। তখন বেতারই ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। টেলিভিশন ছিল কিন্তু তার গন্ডি ছিল হাতেগোনা মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ড্রয়িংরুমে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন শোভা পেত ঠিকই, কিন্তু তাও আবার হাতে গোনা কিছু মানুষের কাছে এবং টেলিভিশনের আবেদন থাকতো মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ইদানীং যেমন পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ব্যস্ততা সত্ত্বেও টেলিভিশনে সন্ধ্যা ও দুপুরের খবর দেখতে ভুল করেন না, তেমনি রেডিও’র সেই যুগে শ্রোতারা সন্ধ্যার এবং দুপুরের খবর বেশ আগ্রহভরে শুনতো। চায়ের দোকানে রেডিওতে খবর শুনতে মানুষ ভিড় করতেন। দুর্যোগ প্রতিরোধে রেডিও’র খবরই ছিল মূল ভরসা। মোট কথা সংবাদপত্রের পাশাপাশি একমাত্র রেডিওই ছিল একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রচার মাধ্যম। এখনো গান, খবর, নাটকের পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যা, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা বিষয়ে নাটক-নাটিকা প্রচার হয়। শ্রোতারা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনে। খবরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি। রেডিও’র খবর এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্যোগ, খেলাধুলা কিংবা ব্রেকিং নিউজ শোনার জন্য রেডিওতে কান পেতে রাখে। রেডিওতে দেশের মানুষ চরম সংকটেও এগিয়ে চলার প্রেরণা খুঁজে পান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত