ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংকটাপন্ন

অলোক আচার্য
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংকটাপন্ন

প্রতিটি মানুষের কাছেই তার ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষা হলো মাতৃদুগ্ধস্বরূপ। আমাদের দেশের ভাষা বাংলা। বাঙালির পাশাপাশি রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আছে অন্তত ৪০টির। গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভিন্ন ভাষার (নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা) মধ্য থেকে কয়েকটি ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। জানা যায়, নৃগোষ্ঠীর ৮টি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আছে প্রায় ৪০টি ভাষার। এর মধ্যে অন্তত ১৪টি ভাষা বিপন্ন। যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে তারা হলো- গারো, হার্জ, ককবরক, কানপুরী, অহমীয়া, বম, চাকমা, খাড়িয়া, খাসি, খিয়াং, কুমি, কোচ, কাডা, কোল, কন্দ, কুরুখ, রিঙ্গম, লুসাই, মাদ্রাজী, মাহলে, মালতো, মনিপুরী, মৈতৈ, বষ্ণুপ্রিয়া, মারমা, ম্রো, মুন্ডারি, সাদ্রি, সাঁওতাল, সৌরা, তঞ্চংগ্রা, থর, তেলেগু, উর্দু, নেপালী, ওড়িয়া, পাংখোয়া, লালেং, রাখাইন ও রেংমিতচা। এগুলো মধ্যে, ৫টি দ্রাবিড়, ১৫টি চীনা-তিব্বতী, ৯টি অস্ট্রো-এশিয়াটিক, ১১টি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছেও তাদের ভাষা সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সেই ভাষা রক্ষায় উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে করে। সেই কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। গাড়ো সম্প্রদায়ের ভাষার নাম আচিক। ভাষাটি কালের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছিল। এ বছর বই বিতরণে খুদে গারো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ভাষার বই দিয়েছে। একটি ভাষা টিকিয়ে রাখতে এ উদ্যোগ অনন্য। রাঙামাটিতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর ২৮ হাজার ৭৪৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তাদের মাতৃভাষায় ৬৪ হাজার বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শিশুকাল থেকেই নিজের মাতৃভাষা চর্চার এবং তা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি হবে। এ অধিকার সবারই থাকে। ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ পদশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায় /নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়- ভাষা নিয়ে এই বিখ্যাত উক্তিটি কবি আব্দুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতার অংশ বিশেষ।

নিজ মাতৃভাষা যারা ভালোবাসে না তাদের সেই দেশেও থাকার অধিকার থাকে না। ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সেটা হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার গুরুত্ব পৃথিবীর সবদেশে, সবকালে সব ধরনের লেখক, কবি, গায়ক, নাট্যকার, পরিচালকের কাছে। সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ যখন আকারে ইঙ্গিতে মনের ভাব লেনদেন করত, তখন ভাষার উদ্ভব সেই কাজটিকে আরো সহজ ও গতিশীল করে তুলেছিল। তারপর ভাষার ক্রমবিকাশে পৃথিবীতে বহু ভাষার আর্বিভাব ঘটে। আমার সময়ের স্রোতে বহু ভাষা হারিয়েও যায়। কিছু ভাষা আবার সময়ের স্রোতে পরিবর্তিত হয়।

কোনো ভাষা বিস্তার লাভ করে। ইউনেস্কোর তথ্য মতে, পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা। অথচ পৃথিবীর বহু ভাষা আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে যথাযথ সংরক্ষণ এবং টিকিয়ে রাখার আন্তরিকতার অভাবে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া অর্থ হলো একটি সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটা। অনেক ভাষা আজ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এভাবে পৃথিবী থেকে হয়তো আরো ভাষা হারিয়ে যাবে সঠিক চর্চা ও গবেষণার অভাবে। ভাষার বৈচিত্র্যতা একটি সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতোই আমাদের দেশে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আর সংস্কৃতির বিকাশ হয় ভাষায়। বাংলাদেশে ঠিক কত নৃ-তাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে তার কয়েকটি তথ্য দেখা যায়। এক তথ্যে বাংলাদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে বলে জানা যায়। কোনো কোনো তথ্যে বাংলাদেশে ২৭টি এবং ২৯টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে বলা হয়েছে। যাই হোক, তারা বাংলাদেশের অধিবাসী এবং তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব।

তাদেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে। বহু নৃগোষ্ঠীর ভাষাও আজ বিপন্ন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রয়েছে গান, কবিতা, ছড়া, মিথোলজি ইত্যাদি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। মায়ের মতোই মাতৃভাষাও যে শ্রদ্ধার, বুক দিয়ে আগলে রাখার। তারপরও ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বা যাওয়ার পথে। একটু সচেতন হলেই বা উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলেই টিকে থাকে। তাদের নিজস্ব জীবন ধারন রয়েছে, সংস্কৃতি রয়েছে এবং ভাষা রয়েছে। তাদের অনেকের ভাষা কথ্যরুপ থাকলেও নেই বর্ণমালা। এটি একটি প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১১ সালে সমীক্ষা থেকে কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পাওয়া গেছে।

২৫টি ভাষায় কথা বলে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৭ জন। ৮টি গোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কথা বলে তাদের মাতৃভাষায়। বিবিএসের মতেম দেশে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে। নৃৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪০টি ভাষার মধ্যে বিপন্ন ১৪টি ভাষা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এর সংশোধনী তপসিল অনুসারে বাংলাদেশে ৫০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রায় ৩৮টি ভাষায় কথা বলে। ২০১৮ সালে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুসারে দেশে প্রায় ৪১টি ভাষা রয়েছে, যার মধ্য থেকে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষা বাদ দিলে ৩৮টিই দেশের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা। বিপন্ন তাছাড়া প্রথমে বাংলা এরপর ইংরেজি এবং তাদের নিজস্ব ভাষা টিকিয়ে রাখা এই তিন চ্যালেঞ্জ তাদের নিতে হচ্ছে। সব কাজেই বাংলা এবং ইংরেজির ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাদের নিজের ভাষার ব্যবহার কোথায়? ভাষার কি মৃত্যু হয়? যখন একটি ভাষা চিরালের জন্য হারিয়ে যায় তখন তার মৃত্যুই হয়।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রীক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২১১৫ সালে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে মাত্র ৬০০টি ভাষা এবং প্রতি ১৪ দিনে পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোনো জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাস। ভাষা হারিয়ে গেলে সেই সঙ্গে তাদের সাহিত্য কর্মেরও মৃত্যু ঘটে। পৃথিবীতে আজ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে গুটিকতক ভাষা। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইংরেজি ভাষা।

প্রয়োজনেই অনেক সময় পরভাষা শিখতে বাধ্য করে। এ যেমন আমাদের দেশের চারিদিকে ইংরেজি ভাষা শেখার, ব্যবহার করার তোড়জোড়। বিপরীতে বাংলা শেখার, ব্যবহার করার অত তোড়জোড় নেই! শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সেই পুরোনো টেপ রেকর্ডার বাজতে থাকে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু সেই কাজটা কীভাবে হবে বা তরুণ প্রজন্মকে শুদ্ধ বাংলা চর্চায় কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, তার কোনো পরিকল্পনা বছরব্যাপী চোখে পরে না। ফলে যা হওয়ার কথা তাই হয়। জাতিসংঘের তথ্যে, বর্তমানে বিশ্বে ৬ হাজার ৭০০ ভাষার মধ্যে ৯৬ শতাংশ ভাষায় কথা বলে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ। যদিও আদিবাসীরা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬ শতাংশেরও কম, তারা বিশ্বের ৪ হাজারেরও বেশি ভাষায় কথা বলে। ভাষাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে এখন ‘বিপন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, বেশিরভাগেরই ২১০০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের অন্তত একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ শুমারি অনুযায়ী, সারাদেশে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যার জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার। যা দেশের পুরো জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ।

২০১২ সালে প্রথম দফায় ৫টি মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেয় সরকার। আর ২০১৭ সাল থেকে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনার জন্য বই বিতরণ শুরু করে। ২০১৭ সালে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য, ২০১৮ সালে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি ও প্রথম শ্রেণির জন্য বই বিতরণ করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা, চর্চা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় এ উদ্যোগ সাফল্যের দাবি রাখে। নিজ মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই বই পড়ানোর জন্য বা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। যারা তাদের মাতৃভাষা সঠিকভাবে শিখতে, চর্চা করতে সাহায্য করবে। একটি শিশু জন্মের পর থেকে তার মায়ের মুখ থেকে যে বুলি শুনে শুনে বড় হয়, সে ভাষাই তার মাতৃভাষা। সেই ভাষার চর্চায় পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার এই লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় সহোযোগিতা প্রয়োজন। যাদের ভাষার লিখিত রুপ নেই, তাদের কথ্য রুপ সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের ভাষার গান, কবিতা এবং সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদান যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা চাই বাংলা যেমন আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের প্রাণের অস্তিত্ত্ব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছেও তাদের ভাষা প্রাণের অস্তিত্ব। সেসবও টিকে থাক বাংলার সঙ্গে সঙ্গে। ভাষার এই বৈচিত্র্যতাই বাঙালির সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত