সম্প্রতি পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করলেই দেখা মেলে বিবাহ বিচ্ছেদের খবর। বিনোদন পাতায় ঘটা করে ছাপা হয় তারকাদের সংসার ভাঙার খবর। আর এমনটি শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছি। এখন আর বিবাহ বিচ্ছেদকে কোনো দুর্ঘটনা মনে হয় না। অন্য আর ৮ থেকে ১০টা ঘটনার মতো বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। বিচ্ছেদ শব্দটা শুনতেই কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করে। অতি মর্মান্তিক একটা শব্দ। তবু কেন এত বিচ্ছেদ প্রশ্ন জাগে মনে। সম্পর্কের বিচ্ছেদ যেন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচ্ছেদ কথাটির মধ্যে কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে তা উপলব্ধি করার শক্তি যেন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিচ্ছেদ কখনো দুটি মানুষের মধ্যে হয় না, এর সঙ্গে জড়িত থাকে আরো মানুষের স্বপ্ন। বিবাহ বিচ্ছেদ একসময় পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদী সমাজের একটি ব্যাধি বলে মনে করা হতো। কিন্তু এটি খুবই দুঃখজনক, আমরা আমাদের দেশে বিবাহিত জীবন অব্যাহত রাখার সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। বর্তমান সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা অহরহ ঘটছে যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে বেমানান। মুসলিম আইন অনুযায়ী, বিবাহ একটি নাগরিক ও পারিবারিক চুক্তি এবং এই চুক্তির মাধ্যমে দম্পতি একটি সুন্দর পরিবার একসঙ্গে থাকার শপথ গ্রহণ করে। বিবাহ এমন একটি পবিত্র বন্ধন যা স্বামী -স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের ওপর স্থায়ী হয়। খুব সুনির্দিষ্ট কারণে তালাক অনুমোদিত, কিন্তু এটি নিরুৎসাহিত, এমনকি কোরআনেও। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন অনুসারে, জরুরি প্রয়োজনে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যেতে পারে। কিন্তু এখন আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই কাম্য হতে পারে না। দুঃখজনকভাবে এটি এখন আমাদের দেশে শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে হরহামেশাই ঘটছে। বিয়ে, পরিবার, সন্তানপালন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ, দায়-দায়িত্ব, টাকা পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা, বিয়ের পরে অন্য নারী বা পুরুষে আসক্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে পরিবারে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
এসব ঘটনায় বাড়ছে অসুখী দাম্পত্য জীবন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে, হচ্ছে। তবু তারা চেষ্টা করেন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বা সামাজিক সমালোচনা এড়াতে অসুখী সম্পর্কটিই টিকিয়ে রাখতে। মূল কথা হলো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ও বিশ্বাস হারিয়ে গেলে তা একটি অস্বাস্থ্যকর ও লোক দেখানো সম্পর্কে পরিণত হয়। তখন সন্তান, দায়-দায়িত্ব সব ঠুনকো হয়ে পড়ে। সম্পর্কটি হয়ে পড়ে সাংঘর্ষিক। নানা রকম আলাপ-আলোচনা করেও যখন সমন্বয় করা যায় না, তখন বিয়ে বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। জোরজবরদস্তি করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলে তাতে নারী-পুরুষ এবং সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হতে পারে। দেশে তালাকের হার বাড়ছে। এই হার রীতিমতো ভয়াবহ। ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে একটি তালাক হচ্ছে। গত বছর রাজধানীতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি করে। সারাদেশেই বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেখা গেছে গত কয়েক বছর ধরেই বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিএস সূত্র অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২০১২ সালে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করা হয়, মোট ৭ হাজার ৪০২টি, ২০১৩ সালে সাত হাজার ৭০৮টি, ২০১৪ সালে নয় গাজার ৪৫টি, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯-এর প্রথম ১৮০দিনে ৪ হাজার ৫০০ তালাকের আবেদন করা হয়েছিল। প্রতি এক ঘণ্টায় একটি পরিবারকে ভাঙার জন্য একটি আবেদন সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়া হচ্ছে। ২২ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে, জুন থেকে অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে, বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেক বেড়েছে। এই সময়ে প্রতিদিন ৩৯টি তালাক ছিল। প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক। প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১৯৪ তালাক হয়। ২০২০ সালে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বিবাহ বিচ্ছেদ ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রামে প্রতিদিন ১৮টি তালাক হয়। সিলেট যেখানে প্রথম ১০ মাসে তালাকের আবেদন জমা ১০ গুণ বেশি হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। আমরা যত উন্নত জীবনযাপনে করতে শুরু করছি, ততটাই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে, সেই সঙ্গে সম্পর্কের মানে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের কাছে। সম্পর্কে তুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয় নিয়ে এখন একটি কথায় আমাদের মাথায় আসে ‘বিচ্ছেদ’ যেন সবকিছু নতুন করে শুরু হবে আবার। কিন্তু বিচ্ছেদের পর কোনো কিছু নতুন করে শুরু হয় না; কয়েকটি জীবন থেমে যায়। হতে পারে শহরে মানুষের সংখ্যা বেশি তাই বিচ্ছেদের হারটাও বেশি। বিবাহ বিচ্ছেদ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে শুধুমাত্র একটি কারণ বিচ্ছেদের জন্য দায়ী হতে পারে না। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা না থাকা এবং পারিবারিক কলহের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদের দারস্থ হতে হয়। বর্তমানে নারীরা তাদের অধিকার ও অবস্থান বিষয়ে সচেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত করে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল দেখা দিলেও দেখা যায়, অনেকেই না মানিয়ে বা সমঝোতায় না এসে বিচ্ছেদকে বেছে নেয়। অন্য নারী-পুরুষের প্রতি আসক্তির কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়; এটি বড় কারণ। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আধিপত্যবাদী মনোভাবও কারণ। একটি যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয় এবং বিচ্ছেদ হয়।
এ ছাড়া পরিবারকে সময় না দেওয়া, কর্মজীবী নারীরা পরিবারে বেশি সময় কাটাতে পারেন না, যাকে অনেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখেন। দাম্পত্য জীবনের ছোট ছোট ভুল মেনে নেওয়ার প্রবণতা না থাকা, স্ত্রীকে যথাযথ ভরণপোষণ না দেওয়া। যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করা, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা এবং বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন পারিপার্শিক কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। বিচ্ছেদের কারণ যাই হোক না কেন, খুব সহজেই চিন্তা করা যায় যে ডিভোর্সের পরিণতি কতটা ভয়াবহ। এই বিবাহ বিচ্ছেদ শিশুদের জীবনকে নষ্ট করে দেয় যদি শিশু থেকে থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদের এই সংস্কৃতি একদিকে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অন্যদিকে শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। বিবাহ বিচ্ছেদ একটি অসম্মানের বিষয় যা নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটি পবিত্র বন্ধন তালাকের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে অসম্মানিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যারা তালাকপ্রাপ্ত হয় তাদের সমাজে তুচ্ছ চোখে দেখা হয়। কিন্তু, বিবাহ বিচ্ছেদে নারীরাই সমাজ দ্বারা হয়রানির শিকার বেশি হয়। এর ফলে অনেক নারী তাদের মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে এমনকি নারীরা তাদের দ্বিতীয় বিয়ের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সমস্যা নারী-পুরুষ উভয়ের হলেও আমাদের সমাজে এখনো বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীদের দায়ী করা হয়। একটি বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে সমাজ যতটা নারীকে দোষারোপ করে ঠিক, ততটা যদি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে তারা আঙুল তুলতে, তাহলে হয়তো বিচ্ছেদের পরিমাণটা কমে যেত। সমাজকে রক্ষণশীল হতে হয় তার মানে এই নয় নতুনত্বের ছোঁয়ায় পাল্টে যাবে সম্পর্কের মানে। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন এবং অবশ্যই এর মূল্য দিতে শিখতে হবে। ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও আইনগতভাবে তালাকের অনুমতি থাকলেও সভ্য সমাজে অহঃরহ তালাক সংস্কৃতি অব্যাহত রাখা উচিত নয়। অতএব, স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ডিভোর্স এড়াতে প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, একে অপরকে সহযোগিতা করার মনোভাব রাখতে হবে। উভয়ের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার মনোভাব থাকতে হবে। তাদের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক করা উচিত নয় এবং সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও নিজেকে সংযত করার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। তাহলেই বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমে আসবে। আমাদেরকে সম্পর্কের মানেটা গভীরভাবে বুঝতে হবে। বিচ্ছেদের আগে অবশ্যই আমাদের পরিবার-পরিজনের কথা মাথায় আনতে হবে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক নয় বরং একজন দায়িত্বশীল সন্তান, পিতামাতা হয়ে উঠতে গেলে সম্পর্কের মূল্য বুঝতে পারাটা জরুরি। বিচ্ছেদ রোধ করার দায়িত্ব শুধুমাত্র সেই দু’জন মানুষের নয়, আমাদের সমাজের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সমাজকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। মানুষ পারিপার্শ্বিকতা থেকে শিক্ষা নেয়। সমাজ যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বিচ্ছেদণ্ডএর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়, তাহলে মানুষ আরেকবার ভাববে একটি সম্পর্ক নষ্ট করার আগে। সকলের সচেতনতাই পারে একটি সম্পর্ক অটুট রাখতে, ‘বিবাহ’ নামক শব্দটাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। সকলকে সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হতে হবে তাহলেই বিচ্ছেদ নামক শব্দের অবসান ঘটবে আমাদের সমাজ থেকে। আসলে বিবাহ নামক এই পবিত্র বন্ধনের প্রতি এখনকার তরুণরা আদৌ কি শ্রদ্ধাশীল হতে পেরেছে? এই বন্ধনটাকে অটুট রাখার জন্য কতটাই বা চেষ্টা করছে? প্রত্যেকটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে একে-অপরের আস্থার প্রতিদান ও ভালো বোঝাপড়ার কারণে। বিবাহ এর বাইরে নয়। কখনো কখনো একজন আরেকজনকে বুঝতে হয়তো কিছু সময় লাগে। পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠতেও দেরি হয়। এ কারণে এখনকার নবদম্পতিদের আবেগের বশে বিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেন না, একটি ভুল সিদ্ধান্তই হতে পারে সারাজীবনের কান্নার কারণ।
লেখক : উপ-পরিচালক (অর্থ ও বাজেট) অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।