ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়। যে ভাষায় কথা বলেছেন আমার বাপ-দাদারা সেই ভাষার কথা বললেই শিকল পরায় হাতে পায়... সেই শিকল পরানোর ভয়কে উপেক্ষা করে নিজের এবং বাপ-দাদার মুখের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সবার আগে এগিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছিল আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একমাত্র উর্দুকেই ঘোষণা দেয়ার পাঁয়তারা করা মাত্রই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ সবার আগে গর্জে উঠে। আর সেই গর্জনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামের আতুরঘরখ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ)। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার প্রবাহে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল বাতিল হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য জগন্নাথ কলেজ আলাদা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলেছিল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার সাবটাইটেল ছিল ‘কি ও কেন?’ যেটির লেখক ছিলেন জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী, বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান। জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সেদিন পোগোজ স্কুল (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) ও সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং স্কুলে ধর্মঘট পালন করে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে সবার নজর কেড়েছিলেন ভাষাসৈনিক মোঃ আবদুল জলিল এবং পরবর্তীতে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার অসামান্য অবদান ছিল। ১৯৫০ সালে তৎকালীন কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক নুরু মোল্লা বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে ‘সর্বদলীয় সেন্ট্রাল কমিটি অব একশান’ নামে গঠিত কমিটির কার্যকরী সদস্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে জগন্নাথ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শফিউদ্দিন আহমদ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় কারাবরণ করেন এবং কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম চলমান ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান গণপরিষদে লিয়াকত আলী খানের প্রস্তাবিত ‘ব্যাসিক পিন্সিপাল রিপোর্ট’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জগন্নাথের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর অধ্যাপক ভাষাসৈনিক অজিত কুমার গুহকে ভাষা আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দীন আহমেদসহ অন্যান্য শিক্ষকরা এখান থেকেই শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনে উৎসাহিত করতেন। ’৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পুরান ঢাকার নবাবপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মিছিল শেষ করে কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রসমাবেশ করে। সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম আবদুর রব, মৃণাল বরড়ি ও খলিলুর রহমানে মতো নাম জানা অজানা অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অসামান্য অবদান রাখেন।’ ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারি ঘোষণা মতে পরের দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করার ঘোষণা দেয়ার পর সন্ধ্যায় নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগদলীয় কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে জগন্নাথের শিক্ষার্থী আনিসুজ্জামান এবং আহমদ হোসেন পর্যবেক্ষক হিসেবে সভায় উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলনে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রফিক উদ্দিন আহমেদ। দিন কয়েক পরই যার দীর্ঘদিনের ভালোবাসার মানুষ একই গ্রামের রাহেলা খাতুন পানু বিবির সাথে বিয়ের তারিখ পাকাপাকি হয়েছিলে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিয়ের শাড়ি-গহনা নিয়ে যার সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কথা ছিল প্রিয়তমার জন্য সেই ২৫ বছরের টগবগে যুবক রফিক উদ্দিন আহমেদ বিয়ের পিড়িতে বসার আগে গিয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে। নিজের জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে বিশ্বভাষায় পরিচিতি লাভ করিয়েছেন কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য মা রাফিজা খাতুনের কাছে কিম্বা প্রিয়তমা রাহেলা খাতুন পানু বিবির কাছে। ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ পৃথিবীর প্রথম ভাষা শহীদ হলেও আজ পর্যন্ত তার কবর নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানি হায়েনারা তাকে মেরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তার লাশ নিয়ে লুকিয়ে ফেলে এবং জনরোষের ভয়ে পরের দিন সেনাদের সহযোগিতায় আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে। তার কবরের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি কিন্তু পৃথিবীর বাঙলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে তিনি আছেন স্বগৌরবে স্বমহিমায়। ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে ১০ জন সরকারঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগন্নাথের শিক্ষার্থী, প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ষাটের দশকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার অনবদ্য দুটি রচনা হচ্ছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’। ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অমর সৃষ্টি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে .....আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী। ২১ শে ফেব্রুয়ারির অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার পর নতুন করে গঠিত হলো সর্বদলীয় রাষ্টভাষা কর্মপরিষদ এবং আন্দোলনকে আরো বেগবান এবং সহজে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য দুটো কেন্দ্র ঠিক করা হলো। কেন্দ্র দুটো হলো নতুন ঢাকার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল এবং পুরান ঢাকার জন্য জগন্নাথ কলেজ। বাঙালি জাতির মহানায়ক, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণার পর আন্দোলনে জগন্নাথের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। লড়াই, সংগ্রাম আর আন্দোলনে পটু বাঙালির গৌরবময় আন্দোলনের মধ্যে ভাষা আন্দোলন অন্যতম। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা রুপে। পৃথিবীতে বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা নিজের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রনীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করে। পৃথিবীর বুকে আজ আমরা অনন্য আমাদের বাংলা ভাষার জন্য। যার জন্য প্রশংসনীয় অবদান রাখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। জগন্নাথের শিক্ষার্থী শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদের স্মৃতি রক্ষার্থে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো বিজনেস স্টাডিজ ভবনের নাম রাখা হয় ‘ভাষা শহীদ রফিক ভবন’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থিত ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারটির সঙ্গে দেশের অন্য শহীদ মিনারের নেই কোন সাদৃশ্য। যে কেউ এটাকে প্রথম দেখাতেই স্থাপত্যশিল্প ভাবতে পারেন সহজেই। দেশের সব শহীদ মিনারে তিন থেকে পাঁচটি বেদি থাকলেও জগন্নাথের শহীদ মিনারে একটি প্রধানসহ মোট বেদির সংখ্যা আটটি। প্রতিটি বেদি বৃত্তাকারে সাজানো। প্রতিটি বেদি নিজ অবস্থানে পেছনের দিকের পাদদেশে কোমর ভেঙে হেলানো। প্রধান বেদিটি দাঁড়ানো অবস্থায় সামনের দিকে অর্ধনমিতভাবে। এ শহীদ মিনারটিতে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ সমাবেশের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করেন বোদ্ধারা। ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথের অবদান বা কার্যক্রম বর্তমান প্রজন্ম খুবই কম জানে। ইতিহাসে নিরপেক্ষভাবে জায়গা পায়নি জগন্নাথ এবং তার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরতে হলে জগন্নাথের সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থী শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ, শফিউদ্দিন আহমদ, আনিসুজ্জামান, আহমদ হোসেন, এম. আমিরুল ইসলাম, জহির রায়হান, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আবদুর রব, মৃণাল বরড়ি, খলিলুর রহমান, মোঃ আবদুল জলিল, অজিত কুমার গুহ, ড. সালাহউদ্দীন আহমেদসহ সবার ভাষা আন্দোলনের জন্য তাদের ত্যাগ এবং আত্মত্যাগের ঘটনা।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত