ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় জীবনে অমর একুশ

বাঙালির জাতিসত্তায় অবিনাশী চেতনা
জাতীয় জীবনে অমর একুশ

বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মৃতি বিজড়িত এই দিনটি সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ দিনটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তায় অবিনাশী চেতনার জন্ম হয়েছিল। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও ৭ শতাংশের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়া হলে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে ক্রমে ক্রমে জোরাল হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। পরবর্তীতে তা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ইস্যু হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের শুরুতে আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করার জন্য ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে জনসমাগম, জনসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ গুলি চালায়। জাতীয় শহীদ মিনার একুশের শোক, সংগ্রাম ও শপথের প্রতীক। শহীদ মিনার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাকেন্দ্র হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে। ১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা। এই চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সে সময়ে বাঙালির আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের যে উদ্বোধন ঘটেছিল তা পরবর্তীতে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। এরপর একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি সংকটের নানা আবর্ত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাববীজ আমরা পেয়েছি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে। একুশের চেতনার তাৎপর্য বহুমুখী। বাঙালির জাতীয় চেতনাকে একুশ দিয়েছে স্ফটিকস্বচ্ছতা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও প্রাণিত করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায়। একুশের চেতনা ক্রমেই পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারে একুশের অবদান অসামান্য। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। একুশের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের বীণা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার। একুশের এই বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। ১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবস উদযাপনে সকল কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখন এসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ। একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। একুশের সাংস্কৃতিক চেতনার অসামান্য ফসল ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা ও বিকাশে আমাদের জাতীয় জীবনে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতি বছর যে বইমেলার আয়োজন করে তা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আর একুশের বইমেলা উপলক্ষে প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে নিত্যনতুন বই। আমাদের সমাজজীবনে একুশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল চেতনার আশাপ্রদ বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়নি। একুশের চেতনার একটি বিশেষ দিক ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এই আকাঙ্ক্ষা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির হাতেই বাংলা ভাষা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ও অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে ইংরেজি ভাষার দখলদারি ক্রমপ্রসারিত হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমবিস্তার, সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজি পাঠ চালু করার ফলে বাংলার গুরুত্ব ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মানসিকতায় বিদেশিয়ানার প্রভাব বাড়ছে। তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে বিদেশি ভাষার আশ্রয় নেয়ায়, বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রে বিদেশি ভাষার ব্যবহারে, দৈনন্দিন বোলচালে বিদেশি বুলির মিশ্রণে, বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তিফলকে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ায়। আমরা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছি যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মাতৃভাষার উন্নতির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। আর সম্ভবত সেই কারণেই এ জায়গাটিতে আমাদের পিছুটান ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। আমরা অনেকেই ভুলে যাচ্ছি, বাঙালির পরিচয়ের মূলভিত্তি তার ভাষিক পরিচয়। ভুলে যেতে বসেছি, আর্থ-সামাজিক জীবনে বাংলা ভাষা যথাযথ গুরুত্ব না পেলে তার শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, একুশের চেতনাই আমাদের নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের প্রেরণা। একুশ আমাদের অহংকার; একুশ আমাদের প্রেরণার অজস্র উৎস। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে অমর একুশ একাধারে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, গৌরবগাথা ও প্রাণভোমরা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল। তাই একুশের অবিনাশী চেতনা আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। এই চেতনা অম্লান রেখে জাতির সব ধরনের কল্যাণ ও অগ্রগতির পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটাতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে একুশের চেতনার পতাকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত