ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বইমেলা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

রূপম চক্রবর্ত্তী
বইমেলা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বইমেলা যখন আসে তখন নতুন বইয়ের এক অদ্ভুত ঘ্রাণ আমার মনকে আন্দোলিত করে। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বই কেনার অভ্যাসটা পরিবর্তন করতে পারিনি। আমরা যারা আগে বই কিনতাম তাদের অনেকের সে অভ্যাসটার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। বই পড়ার অভ্যাস থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ম দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। ছোট বেলায় মা-বাবার অজান্তেই অনেক বই কিনেছি এবং পুরো বইটি মনযোগ সহকারে পড়েছি। আবারো শুরু হয়ে গেল বইমেলা। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পড়ো বই, গড়ো দেশ : বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। গত ১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলা-২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে চাই, তাহলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমি প্রকাশকদের অনুরোধ করব, শুধু মুদ্রিত বই নয়, ডিজিটাল বইও প্রকাশ করুন।’

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বই প্রকাশনা এবং অনুবাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি মাঠে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি স্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ বছর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়নও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। প্রতি কর্মদিবসে বইমেলা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং সরকারি ছুটির দিনে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এ বছর ১১টি বিভাগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ দেওয়া হয়। বিভাগগুলো হলো- কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ-গবেষণা, অনুবাদ, নাটক, শিশুসাহিত্য বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, পরিবেশ-বিজ্ঞান ক্ষেত্র, জীবনী এবং লোক কাহিনী। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন- শামীম আজাদ (কবিতা), ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী (যৌথভাবে কথাসাহিত্যে), জুলফিকার মতিন (প্রবন্ধ-গবেষণা), সালেহা চৌধুরী (অনুবাদ), নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক (যৌথভাবে নাটক), তপঙ্কর চক্রবর্তী (শিশু সাহিত্য), আফরোজা পারভিন এবং আসাদুজ্জামান আসাদ (মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা), সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং মো. মজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা), পক্ষীবিদ ইনাম আল হক (পরিবেশ-বিজ্ঞান ক্ষেত্র), ইসহাক খান (জীবনী) এবং তপন বাগচী ও সুমন কুমার দাস (যৌথভাবে লোক কাহিনী)। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ কিছু বক্তব্য আমার মনে দাগ কেটেছে। তার বক্তব্যের গুরুত্ব বিবেচনা করলে অনেক বিশদ বিবরণ লেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা আমাদের দিয়েছেন, সেভাবে আমরা চলতে পারলে মানুষের অনেক মঙ্গল হবে। সরকারের ভিশন-২০৪১-এর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জনসংখ্যা, সরকার, অর্থনীতি ও সমাজকে স্মার্ট করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে স্মার্ট হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যদি একটি স্মার্ট সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সবকিছুকে সমৃদ্ধ করতে হবে।’ এখন বইমেলা জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পর্যায়ক্রমে এই বইমেলাকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাবে। প্রকাশকদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, ডিজিটাল প্রকাশক হলে বিদেশের সব মানুষের কাছে তাদের বই পৌঁছে যাবে। তিনি বলেন, ‘অন্য ভাষাভাষীর মানুষও বইগুলো পড়তে পারবেন।’ শেখ হাসিনা অনুবাদ সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘একসময় অনেকেই বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ না করার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু আমি অনুবাদের পক্ষে। অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদ না হলে আমরা কীভাবে অন্য জাতি, দেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানব?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একই সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বাংলা সাহিত্য যেমন অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে পারবে, তেমনি বাংলা সাহিত্য পড়ার সুযোগ পাবে। বইমেলার কথা লিখতে গিয়ে অতীত ইতিহাসকেও স্মরণ করতে হয়। ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরো অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে। ২০২০ সালের মেলার উদ্বোধনপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ‘গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘বইমেলা’ শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রুতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মতপ্রকাশ করেন।

এর পরের বছর বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’। ভালো বই পড়ে প্রকৃত জ্ঞান লাভের অভাবে তরুণ প্রজন্মের বিশাল অংশ নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না। কোনো কোনো কিশোর অপরাধী এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যেখানে দেখা যায়, সমাজে আইন মেনে চলা মানুষরা তাদের ভয় পান। একজন কিশোর অপরাধী বিভিন্ন অপরাধ করার পরও ভাবছে সে, যে কাজ করেছে সেটিই সঠিক। একজন কিশোর অপরাধী প্রথমত দায়বদ্ধতা অস্বীকার, তারপর আঘাত অস্বীকার, ভুক্তভোগীকে অস্বীকার, নিন্দুকের নিন্দা এবং উচ্চতর আনুগত্য এই পাঁচটি টেকনিকের নিরিখে নিজেকে সঠিক হিসেবে জাহির করে। আবার কোনো কিশোর অপরাধী চাল চলনে খুব ভয়ংকর হয়ে উঠে। তারা কিছুকে তোয়াক্কা করে না। বড় জনদের সম্মান করে না। এরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বই পড়ার মানসিকতা বাদ দিয়ে আমাদের কিশোররা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। এই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ সবকিছু আলাদা। মারামারি, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ঙ্কর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি খুনখারাবিসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ভবিষ্যৎ সমাজের অপার সম্ভাবনাময়ী তরুণ এবং কিশোর সদস্যরা। আজকে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সবার ভাবতে হবে। ডিজিটাল সংস্কৃতির সঙ্গে যেমন যুক্ত থাকতে হবে, ঠিক একইভাবে ছাত্রছাত্রী, তরুণ এবং কিশোর-কিশোরীদের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা রাখতে হবে। বই বাদ দিয়ে আমাদের সন্তানদের কেউ কেউ ভিন্ন পথে পরিচালিত হচ্ছে দেখে অনেক সময় মর্মাহত হয়ে পড়ি। কেউ খারাপ পথে পরিচালিত হোক এটি আমাদের কাম্য হতে পারে না। অনেক কিশোর অপরাধী এমনভাবে মগজ ধোলাই পায়, যার জন্য তাদের কাছে অপরাধ করার পর কোনো অনুশোচনা থাকে না। এই ধরনের অপরাধী তার কৃতকর্মের জন্য এমন সব যুক্তি দাঁড় করায়, যাতে তার কোনো অপরাধবোধ বা অনুশোচনা থাকে না। এ কিশোরদের উদ্ধার করতে হবে। এদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। খবরের কাগজ খুললেই বিভিন্ন সময় কিশোর গ্যাং নিয়ে লেখালিখি হচ্ছে। বিপথগামী শিশু ও তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ এখন গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত। শহর থেকে এখন গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে এমন অপরাধের ঢেউ। শিশু-কিশোরদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ঙ্কর এই গ্যাং সংস্কৃতি। গ্যাং সংস্কৃতির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ইন্টারনেট প্রীতি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে অভিভাবক মহল থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্য দেশের শিশু, কিশোররাও নিজেদের যুক্ত করেছে বেপরোয়া গ্যাং কালচারের সঙ্গে। এই কালচার যদি চরমে উঠে দেশের কেউ ভালো থাকতে পারবে না। উগ্রতা না শিখিয়ে ছেলেমেয়েদের কাছে ভালো বই এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক নির্যাস তুলে ধরতে হবে। লেখাপড়া জানা কিছু ছাত্রের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের কম লেখাপড়া জানা ব্যক্তিদের সন্তানগুলো টাকা-পয়সার লোভে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। যত প্রযুক্তির উন্নয়নের জোয়ারে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তত অপরাধী কিশোরের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই চলুন পর্যাপ্ত কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কিশোরদের আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা করি। একজন সন্তানের উপর তার মা-বাবার অনেক আশা থাকে। অনেক স্নেহ মমতা আর ভালোবাসায় একজন সন্তানকে তার মা-বাবা গড়ে তোলেন। প্রতিটি সন্তান-সুসন্তান হয়ে দেশের সেবাই আত্মনিয়োগ করুন। সব রকম মাদকতা, হিংসা, অহংকার আর অন্যায়কে আমাদের কিশোররা ঘৃণা করতে পারে। আমাদের সন্তানদের হাতে ভালো বই তুলে দিতে হবে, যাতে তারা বইপ্রেমিক হতে পারে। বইয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করা গেলে অনেক অপরাধ কমে যাবে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্য, কর্ম এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে গেছেন।

বাংলা ভাষাকে আরো বেশি করে জানার জন্য বই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেই চলেছে। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে তারপরও সব বাধা অতিক্রম বইমেলার পরিধি দিনদিন বেড়ে চলেছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। বই মেলার আগত প্রকাশক এবং লেখকরা উৎসাহিত হবেন, যদি আমরা বেশিবেশি বই পড়ি এবং পড়ার সঙ্গে বই কেনার মানসিকতাও থাকতে হবে।

বই কিনতে গিয়ে বাঙালি যখনই অপচয়জনিত একটি সমস্যার সামনে পড়েন আর তখনই মনে আসে সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না’।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত