ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বসভায় স্বীকৃত

মো: মসিউর রহমান হিমেল
একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বসভায় স্বীকৃত

যখন কোনো মানব শিশু পৃথিবীকূলে জন্মগ্রহণ করে, তখন তাকে কোনো না কোনো একটা নামে ডাকা হয়। এটা যেমন নব-জাতকের একটা জন্মগত অধিকার, নিজের মায়ের ভাষায় তথা তার নিজস্ব ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করাও শিশুটির জন্মগত অধিকার। এ অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নয়; এটা সম্পূর্ণ প্রকৃতি প্রদত্ত। পৃথিবীর যেই অবস্থানে বা প্রান্তেই তার জন্ম হোক না কেন, সে তার আপন ভাষায় সব অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে করবেই। আর এটা জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুর মতোই পরম সত্য। ইহার মতো আর বড় সত্য এ জগতে নেই। পৃথিবীর অভ্যন্তরে বহুভাষা আছে, আর এই বহু ভাষাভাষীর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে- বিশ্বমানব বসতি। পৃথিবীতে বহু তার অস্তিত্ব ছিল, এখনো আছে, আবার থাকবে। কালের করাল গ্রাসে কিছু ভাষা বিলুপ্তও হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে ভাষা বা উপভাষার নিজস্ব গুরুত্ব কোনো ক্রমেই ক্ষুণ্ণ হয়নি। মানুষের মুখের ভাষা কত মর্মস্পর্শী তা কিছুটা উপলব্ধি করা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি কটাক্ষ করে বেফাঁস কিছু বলে ফেললে, মারামারির মতো অবস্থা দাঁড়াই। ভাষা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রতিনিয়ত একাত্ব হয়ে রয়েছে- তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির ভাষা রয়েছে। এই সব ভাষা কিন্তু ব্যকরণ সিদ্ধ নয়। অঞ্চল বিশেষে একই ভাষা বিভিন্ন ঢং এ ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও পণ্ডিতদের কাছে ভাষা পরিভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এটা রীতিমত একটা গবেষণার বিষয়বস্তু। তাই নির্দ্ধিধায় বলা যায়, আজও বাংলাদেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী ব্যকরণ স্বীকৃত সাধু বা কথ্য ভাষায় কথা না বলে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছদ্যবোধ করে। ভাষার এ গতি পথরুদ্ধ করার সাধ্য কিন্তু কারো নেই। প্রাকৃতিক জলবায়ুর মতো ভাষাও; কিন্তু আপন সত্ত্বায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বলেই ভাষা; মাতৃভাষা আরো বেশি মর্মস্পর্শী, বেশি গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রক্ত গঙ্গা বয়ে যায়। পাক সরকার রক্ত চক্ষু দেখিয়ে এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি মাতৃভাষার মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত করতে পারেনি শকুনি শাসকচক্র। আমাদের বীর সন্তানদের বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মাতৃভাষার মর্যাদা। তারা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের অমূল্য জীবন। অপরিসীম সাহসিকতায়-শাসকগোষ্ঠীর ভ্রুকুটির নিকুচি করে মাথা নত না করার মতো এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এই সবুজ বাংলা মায়ের অনুগত সন্তানরা। এতে হতবাক হয়েছে বিশ্ববাসী, তাই মস্তক নুইয়ে আসে বীর সন্তাদের মাতৃপ্রেম, ভাষা প্রেম ও দেশ প্রেম দেখে। বিভিন্ন দেশ জয়ে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য, আর্থিক অধিকার ও বাঁচার অধিকার আদায়ের জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে, নানা কারণে মানুষ প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। বাংলার সূর্য সন্তানরা ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন ভাষার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি এদিন ঘটলেও তার ঐতিহাসিক পটভূমি রচিত হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই অর্থাৎ ১৯৪৭ এ অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার অধিকারের বিষয়ে স্বেচ্ছাচারিতার ঘৃণ্য পরিচয় দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মতামত উপেক্ষা করে একটা অযৌক্তিক পদক্ষেপের পরিণাম শুভ নয় জেনেও নিলর্জের মতো প্রচণ্ড আঘাত করে। প্রতিবাদ তখন তুঙ্গে উঠে, প্রতিরোধ উচ্চকিত হয়- রাজপথে, সংসদে। সর্বস্তরের মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার সত্ত্বেও পাক শাসক চক্র উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার একটা হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ঘনিয়ে আসে ৫২-এর সেই রক্ত ঝরা দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। আর বুকের তাজা রক্ত দিয়েই রাখতে হলো- মায়ের ভাষার মান। শহীদ হলো- রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, আরো অনেক নাম না জানা কত। কবির ভাষায় ‘এক থোকা নাম’ রচিত হলো রক্তে লেখা এক ইতিহাস। নির্মিত হলো বাংলার মাটিতে শহীদ মিনার, সূচিত হলো স্বাধীকার আদায়ের স্তম্ভ। অবাক বিষ্ময়ে পৃথিবীর লোক প্রত্যক্ষ করল বাঙালি জাতির এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মর্মস্পশী গীত রচিত হলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভূলিতে পারি’ এই অমোঘ সুর ও বাণীতে গোটা জাতি এই ভূমিকায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ভালবাসায় আবেগ আপ্লুত অশ্রু সজল হয়ে পড়ল। সেই মহান ৫২-এর পর থেকে প্রতিটি ২১ ফেব্রুয়ারিতে মানুষ প্রভাত ফেরির মধ্যে দিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হয়, শহীদদের প্রতি তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে আসে। সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষার জীবন বিসর্জন দিয়ে তারা আপামর হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা সবাই শহীদ মিনারো যাব, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে। বর্তমানে তাই ২১ ফেব্রুয়ারি ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন আঙিকে প্রতিপালিত হয়। কারণ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বসভায় স্বীকৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বসভায় তার স্বীকৃতির মাধ্যমে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এটা কিন্তু কোনো অংশে কম গুরুত্ব বহন করে না। আমরা মে দিবসের কথা সবাই জানি, ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শিকাগোর মেহনতি মানুষদের হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করেই বিশ্ববাসী; কিন্তু ১ মে দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে তাদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। একইভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি দুই দশকের বেশি সময়ধরে গোটা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এটা বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব ও পরম অহংকারের। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভের পেছনে যাদের অবদান রয়েছে, তারা সবাই ধন্যবাদের পাত্র, শ্রদ্ধার পাত্র। ভাষা শহীদ জব্বারের জন্মস্থান গফরগাঁও থেকে গফরগাঁও থিয়েটার নামক সংগঠন, ইনামূল হক, কানাডায় বহু ভাষিক ও বাহু জাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ, প্যারিস জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংগঠর ইউনেস্কো, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলা একাডেমি ও অন্যান্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবেসের মর্যদা পায়। তাই গত দুই দশকের অধিক সময় থেকে মে দিবসের মতো গোটাবিশ্বে এর আগে প্রায় ১৯৪টি দেশে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে পালিত হয়েছে। আশা করছি এবার বিশ্বের আরো অধিক দেশে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে উদযাপিত হবে। আর এই অভাবনীয় সাফল্যে যাদের অবদান রয়েছে বিশেষ করে তাদের প্রত্যেককেই আমাদের সশ্রদ্ধা অভিনন্দন ও সালাম জানাই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত