১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। এই উপমহাদেশে দীর্ঘ দুইশত বৎসরের ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান ঘটল। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সচেতন বাঙালি জনসমাজ পাকিস্তানের অধীনে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসিক প্রস্তুতি নিল। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের সূচনা হলো। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানের সরকার ‘উর্দু’কে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা করার চক্রান্ত করল। ষড়যেেন্ত্রর শিকার হলো বাঙালি জনগণ। অবশেষে অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময়, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাঙালি জনসমাজ পাকিস্তানি শাসকদের চক্রান্তের নীলনকশাকে ছিন্ন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং অনেক নাম না জানা সূর্য-সৈনিকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো। এক সাগর রক্তের মাঝে জন্ম হলো শহীদ মিনারের। বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা, বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ রক্তস্নাত আন্দোলনই ভাষা আন্দোলন হিসাবে পরিচিত। ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হলেও এর সূত্রপাত হয় পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য গঠিত ৭৯ সদস্য বিশিষ্ট ‘গণপরিষদ’ যখন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে তখনই মাতৃগর্ভে এ আন্দোলনের ক্রমরূপান্তর ঘটতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানি বেনিয়া শাসকচক্র বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষায় সর্বপ্রথম আক্রমণ করল ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষাসম্মেলনে। বিভিন্ন সংগঠক ও শিক্ষাবিদদের দ্বারা শাসক মহল ‘উর্দু’কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা করার জোর দাবি জানাল। এর প্রতিবাদে গর্জে উঠল বাঙালি জনসমাজ। যে কোনো মূল্যে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহারের অভিপ্রায়ে ছাত্র, শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের একাত্মতায় গঠিত হলো ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের কার্যক্রমের ভাষা ‘উর্দু’ ও ‘ইংরেজি নির্ধারিত হলে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানবাসীদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ’৪৮ সালের ১১ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হলো। ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। তদানীন্তন সরকার এ মিছিলের উপর লাঠিচার্জ করল। কয়েকজন ছাত্র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ফলে আন্দোলনের উত্তাপ সইতে না পেরে এবং সংগ্রাম পরিষদের চাপের মুখে পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভা বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সম-মর্যাদা দানের সুপারিশ করে একটি প্রস্তাব পাশ করতে বাধ্য হলো ’৪৮ সালের ১৪ মার্চ। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল কায়েদ-এ-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের সফরে আসেন। ’৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দানের প্রাক্কালে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গেই মাতৃভাষায় গর্জে উঠল শত সহস্র বাঙালি কণ্ঠ। ’৪৮ সালের ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেবের কণ্ঠে একই কথা পুনর্বার উচ্চারিত হলে ছাত্ররা চরম বিক্ষোভে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। জিন্নাহ বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই হল ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ইতিহাসে এদিনই ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সবচেয়ে ব্যর্থতম দিন। তারপর জিন্নাহ-সংগ্রাম পরিষদ বৈঠক হলো। যুক্তি ও পাল্টাযুক্তির মধ্যদিয়ে জিন্নাহ সাহেব একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বৈঠক শেষ করলেন। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলী খান কর্তৃক মূলনীতি কমিটি ‘উর্দু’কে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা করার প্রস্তাব দিয়ে গণপরিষদের কাছে রিপোর্ট পেশ করলে সচেতন বাঙালির এবং গণপরিষদে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের সদস্যদের তীব্র প্রতিবাদে তা পরিষদে ঠাঁই পায়নি। লিয়াকত খানের পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। বাঙালি জনসমাজ নতুন করে স্বপ্ন দেখল; কিন্তু নাজিমুদ্দিনের রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে পুরোনো কথা সুরই পুনরায় ধ্বনিত হলো। বাঙালির স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ল। ফলে বাঙালি পুনরায় প্রতিবাদ করল। ’৫২-এর ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদসভা শেষে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হল গঠন করা হল দলমত নির্বিশেষে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ’৫২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানো হলো এবং ধর্মঘট পালিত হলো। তারপর সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের তদানীন্তন সরকার এ কর্মসূচিকে প- করার লক্ষ্যে ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের প্রত্যেকটি প্রধান শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলেন। সচেতন ছাত্রসমাজ মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ১৪৪ ধারাকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ল ঢাকার রাজপথে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে। বুকে তাদের অদম্য সাহস, মুখে তাদের প্রতিবাদের সুর।
এরই এক পর্যায়ে নুরুল আমিন সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী ছাত্র জনতার মিছিলের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করল। পুলিশের গুলিতে ঢলে পড়ল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরো কত নাম না জানা মুখ। তাদের বুকের তপ্ত রক্তস্রোতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পিচঢালা কালো পথ রঞ্জিত হলো। এ সংবাদে সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ একই সুরে চরম বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। আন্দোলন এক গণবিস্ফোরণে রূপ নিল, যার ফলশ্রুতিতে তৎপরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ছিল জাতির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি অন্যায়-অত্যাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের শিক্ষা লাভ করে। এ আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও এটি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনুপ্রবেশ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তাইতো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্রমবিকাশে যে সুর ধ্বনিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির স্বাধীন জাতীয় সত্তা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে সুরের সার্থক বাস্তবায়ন ঘটেছে। ফলে সমগ্র বাঙালি জাতির চিন্তায় ও চেতনায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।