ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনীতির নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ

মো. মাঈনউদ্দিন
অর্থনীতির নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে উঠে আসে মূল্য, ডলার সংকট, হুন্ডি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা দুর্নীতি ও বৈষম্য প্রসঙ্গ। সংবাদপত্র ও টিভির টক শোতেও এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দেখা যায়। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবস্থা। এছাড়া অর্থনীতিতে রয়েছে নানা ক্ষত, সংকট ও চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা। ডলার বাজারে শীতলতা আনা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধি করা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি বাজার ঠিক রাখা, অর্থপাচার, সিন্ডিকেট দমন, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান পাঁচটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে জ্বালানি স্বল্পতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্য ঝুঁকিগুলো হলো উচ্চমূল্য, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া? সম্পদ ও আয় বৈষম্য, সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। শিল্প খাতের বড় সমস্যা হলো চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকা অন্যদিকে ক্ষুদ্র বাজারি শিল্পগুলো চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না। একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। শিল্পের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, তার মানে বেকারত্ব বৃদ্ধি প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। অর্থনীতিতে ক্রমাগতভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাবে নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তসহ সবাই বড় কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রভাবের মধ্যে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। পরোক্ষ প্রভাব হলো উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘবিরোধী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার মুখে পতিত হওয়া। উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে লেনদেনের ভারসাম্য থাকে না। ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র এলসি খুলতেও সমস্যা হয়। রপ্তানিকারকদের রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়? অর্থনীতির গবেষণার গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে অর্থনীতিতে বড় ক্ষত হলো বৈষম্য ও দুর্নীতি। গিনি সহগের মাত্রা থেকে জানা যায় দেশের বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিতে সম্পদ ও আয় উভয়ের মধ্যে বৈষম্য উন্নততম ঝুঁকির কারণ। সিপিডির গবেষণায় দেখা যায় উচ্চ আয় বৈষম্য থাকলে নিম্ন-মাধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তেমন। একটি বাড়ে না। সমাজে উচ্চ শ্রেণির মানুষের হাতে সম্পদ ও অর্থ জড়ো হলে তারা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে না। অনেকে অর্থ বিদেশে ব্যয় করেন। মধ্যম শ্রেণির ভোক্তারা হলো সমাজের মূল ভোক্তা। তাদের আয় না বাড়লে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি কবে যায়? সমাজে উচ্চ বৈষম্য থাকলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একসময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা দেখা দেয়। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আব্দুলনির্ভর অর্থনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে আবদালী বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর ক্ষত ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্প খাতে সব উপকরণ আমদানি করা উৎপাদন ও নতুন শিল্প স্থাপন হ্রাস পেয়েছে ফলে দেশি-বিদেশি সব পণ্যের দাম ও মূল্য স্ফীতি বাড়ছে। কমে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রার মান? সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিলেও শতভাগ মার্জিনে অনেকেই এলসি করলে ডলারের কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে দেনা শোধ করতে হচ্ছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ও কাঙ্ক্ষিত হারে না আসায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ দিন দিন বাড়ছে। চলমান ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেসঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়িয়ে অর্থছাড় বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগ ইআরডি সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের ২০২৩-২৪। ছয় মাসে জুলাই-ডিসেম্বর সরকারকে বৈদেশিক অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। যার টাকা রূপকে প্রায় ১৭ হাজার ২৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কত অর্থ বছরের একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার? এই সবে তুলনামূলক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের ২০২৩-২৪ সালে ৬ মাসে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে তার মধ্যে সুদ ছিল ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। গত অর্থ বছরের ২০২৩-২৪ একই সময়ে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ হয়েছিল তাতে সুদ ছিল ২৭ কোটি ৫১ লাখ ডলার। সুদ পরিশোধে সুদের পরিমাণ সামনের দিকগুলোতে আরো বাড়বে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ডক্টর জাহিদ হোসেনের মতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত যে হারে অর্থ ছাড় হয়েছে পরিশোধ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। তবে যে হারে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেগুলো থেকে যদি ছাড় ঠিকমতো হয় তাহলে সমস্যা হবে না। তবে এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে অর্থ ছাড়ানো হবে না, বিষয়টিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানসম্মত উন্নয়ন কার্যক্রম দৃষ্টিতে পাশাপাশি মানসম্মত উন্নয়ন কার্যক্রম নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের দেরি। দেরি হওয়ার প্রবণতা ও ব্যয়বৃদ্ধি এড়াতে দক্ষ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের প্রতি জোর তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। এই উপলব্ধি অবশ্যই প্রশংসনীয় তবে প্রকল্প প্রকল্পের দুর্নীতি অনিয়ম ও অপচয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ইআরডির হিসাব থেকে দেখা যায়, আগামীতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে ইআরডির প্রকল্প অনুযায়ী ২০২৬ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের জীব চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এর ঋদের পাঁচ বছরের রেয়াত শেষ হয়েছে গত এপ্রিল ২০২৩-এ। ফলে চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) এই ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬ সালের পর মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের আসল পরিশোধ শুরু হবে, তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে তাই বৈদেশিক। ঋণ পরিশোধের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য সক্ষমতা বাংলাদেশকে কি অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবাদের থেকে দেখা যায়, করোনার পর অর্থনীতি যখন পুনঃরুদ্ধার হচ্ছিল তখন আমদানি বাড়ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ১৯.৫০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৭.৫২ শতাংশ। অথচ বর্তমানে আমদানি কমার কারণে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামালের সংকটের কারণে রপ্তানি খাতে উৎপাদন কমেছে, ফলে রপ্তানি আরও কমেছে। অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ১ শতাংশ। আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ। বিনিয়োগ কমে গেছে ঋণ প্রবাহও কমেছে।

বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। সরাসরি বৈদেশিক এফডিআই কমেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় এফডিআই কমে ৪ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলার উঠেছিল। আমদানি চাপে রিজার্ভ কমতে থাকে এখন। কমে তা ২ হাজার ৫০২৭ কোটি ডলার নেমেছে। ডলারের দাম ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও টাকার মান কমার কারণে মূল্যের হার বেড়ে চলেছে। বর্তমানে তা বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হার বেড়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছিল। চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে অল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়ে চলেছে। জনগণ এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়- তাই মূল্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মদতদারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাজার নজরদারির দাবিতেও প্রযুক্তি সহায়তা আনতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি আমাদের রাজনীতিবিদদের সততার চর্চা বাড়াতে হবে এবং সরকারি আমলানির্ভরতা কমাতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। আমাদের রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে, যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের সহায়তা দিতে হবে। আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ উৎপাদনমুুখী ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নিষ্ঠার যে অভাব রয়েছে তা পূরণ করতে হবে। উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং উন্নয়ন হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত