ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মিয়ানমারে উত্তেজনা এবং রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

রায়হান আহমেদ তপাদার
মিয়ানমারে উত্তেজনা এবং রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার ৬ বছর পার হয়ে গেলেও সংকট সমাধানে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগ্রহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বরং ফিকে হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমারে আবারো সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সবসময়ই সবকিছু পরিচালনা করেছে। সামরিক সরকার এখন মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থি এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এত কিছুর পরও মিয়ানমার কিংবা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কেন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারছে না? এর বড় কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব। মিয়ানমার নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো বেশ উদ্দীপ্ত এ মুহূর্তে। এই উদ্দীপনার জোয়ারে অনেকগুলো বাস্তব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, দেশটির গৃহযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী হেরে যাচ্ছে কি না? এবং দেশটি চীনের প্রভাব থেকে মুক্তি পেয়ে পশ্চিমের প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়ছে কি না? তবে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো- মিয়ানমার বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে কি না এবং ওদিক থেকে আসা আরো আশ্রয়প্রার্থীকে জায়গা দিতে হবে কি না? তা এখন শুধুই অপেক্ষার প্রহর। ওদিকে গত ৩ বছর চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রায় শর্তহীনভাবে মদদ দিয়ে গেছে। তবে চীন দেশটির প্রান্তিক সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোকেও সহায়তা দিয়েছে। তবে চলতি গৃহযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বামার-জনতার একাংশও তাতমাদোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। সুতরাং, সশস্ত্র বাহিনী এই প্রথম তাদের ঐতিহাসিক নিরাপদ এলাকায় মুশকিলে পড়েছে। প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতির গেরিলা দল বামার অঞ্চলের এই অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে পুরো ফায়দা তুলে যার যার প্রভাবের পরিসর বাড়িয়ে নিচ্ছে এখন।

বর্তমানে বাংলাদশসহ বহির্বিশ্বে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোণঠাসা হওয়ার যেসব সংবাদ মিলছে, তা মূলত আঞ্চলিক গেরিলা দলগুলোর দ্বারা ঘটছে। মিয়ানমারে এদের বলা হয় এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন বা এথনিক রেজিস্ট্যান্স ফোর্স। তাতমাদো-বিরোধী সশস্ত্র বামারদের সামরিক সমঝোতা থাকায়, প্রথমোক্তরা যত সফলতা পাচ্ছে, শেষোক্তরা তত বলীয়ান হচ্ছে। যদিও ভৌগোলিক হিসেবে দেশটির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ এলাকায় সংঘাত ছড়িয়েছে; কিন্তু কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তাতমাদোর নিয়ন্ত্রণ এখনো বেশ নিরঙ্কুশ। দেশটির প্রধান জনগোষ্ঠী বামাররা বেশি থাকে এই মধ্যাঞ্চলে। সেনাবাহিনীও যেহেতু প্রধানত বামারদের, সে কারণে এই অঞ্চলে শিগগিরই তারা প্রভাব হারাবে বলে মনে হয় না। প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও এখনো তাদের সঙ্গে আছেন। পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে পরিচিত বামার তরুণদের গেরিলা দলগুলোকে ইএও প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জুগিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে পিডিএফ অঙ্গীকার করেছে তাতমাদোকে হারাতে পারলে মিয়ানমারের প্রান্তিক জাতিগুলোর এলাকায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং দেশটিকে একটা বিকেন্দ্রীকৃত ফেডারেশন আকারে গড়ে তোলা হবে। আপাতত সেটি একটি স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নকে মিয়ানমারে একদম অধরা কিছু মনে করা হয় না এখন আর। এই স্বপ্ন সফল হলে কেবল মিয়ানমারই পাল্টাবে না, আশপাশের জাতিরাষ্ট্র গুলোতেও তার ছাপ পড়বে।

আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, মিয়ামারের চলতি ঘটনাবলিতে চীনের অবস্থান নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে বলে মনে হয়। নেপিডোর এখনকার শাসকদের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা যে বহুকাল ধরে চীন থেকে এসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত গত ৩ বছর চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রায় শর্তহীনভাবে মদদ দিয়ে গেছে। তবে চীন দেশটির প্রান্তিক সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোকেও সহায়তা দেয়। এই সহায়তার ভেতর বুদ্ধি-পরামর্শের বাইরে বাড়তি কিছুও থাকে। যেহেতু মিয়ানমারজুড়ে চীনের বহু ধরনের বিনিয়োগ আছে, সে কারণে বেইজিং বহুদিন হলো এই কৌশলে কাজ করে। তবে দেশজুড়ে সামরিক শাসনবিরোধী সশস্ত্রতা যত বাড়ছে, চীন ইএওর সঙ্গে সম্পর্ক তত আরো নিবিড় করছে। এটা হলো আপাতত মিয়ানমারে চীনের একটি নতুন প্রবণতা। এই কৌশল গ্রহণ করে চীন তাতমাদো-বিরোধীদের এটা বোঝাতে চায়, পশ্চিমের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর দরকার নেই তাদের। বেইজিংয়ের এ রকম সবুজ সংকেত পাওয়ামাত্র ইএওর তিন-চারটি গ্রুপ তাতমাদোর বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত