ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খতনায় দুটি মৃত্যু : অনেক প্রশ্ন

হাজাম যুগে ফিরে যাওয়ার পদধ্বনি!
খতনায় দুটি মৃত্যু : অনেক প্রশ্ন

অল্পদিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় খতনা করতে দুটি শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা মানুষকে মর্মাহত করেছে। এ নিয়ে এখন দেশজুড়ে চলছে আলোচনা। সামান্য একটি অপারেশনে দুটি নিষ্পাপ শিশু মারা গেল। মহান আল্লাহ যেন তাদের অভিভাবকদের এই শোক কাটিয়ে উঠার তৌফিক দেন, সেই কামনা থাকবে। তবে আগামীতে আর যেন কোনো অভিভাবক এভাবে শিশুসন্তান হারা না হন, সেইদিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়াস্থ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারটির সবধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খতনা করাতে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় আহনাফ তাহমিন আয়মান নামে এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার খবর পেয়েই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। খবরটি জেনেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মঈনুল আহসানকে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে পাঠান এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। পরিচালক (হাসপাতাল) দ্রুততম সময়ে জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপস্থিত হয়ে হাসপাতালটির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা দেন এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনকে কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন।

তিনি বলেছেন, কিছুদিন আগেও এমন একটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। সে ঘটনায় আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছি। তবে সেই ঘটনার পরও যারা সতর্ক হতে পারেনি, এরকম আর কারো কোনোরকম দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে শুধু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে না, ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলাকারী দোষীদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এরকম গুরু দায়িত্বে অবহেলা করতে সাহস না পায়। চিকিৎসায় অবহেলা পাওয়া গেলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনায় আহনাফের বাবার মামলার প্রেক্ষিতে সেখান থেকে একজন পরিচালক ও একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টকে পুলিশ এর মধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আগামী রোববার মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই তড়িৎ পদক্ষেপে মানুষ আশ্বস্ত হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। সাধারণ মানুষের ধারণা খতনার কাজটি করতে গিয়ে হাজাম নামে একজন হাতুরে ডাক্তার সেখানে সফল হচ্ছেন, সেখানে আধুনিক যুগে এত বড় ডিগ্রিধারী মেডিকেল চিকিৎসকদের হাতে কীভাবে দুটি শিশু অল্পদিনে ব্যবধানে মারা গেল, সেটাই প্রশ্ন। ছেলে শিশুদের খাতনা করা ধর্মীয় দৃষ্টিতে সুন্নত। এই সুন্নতে খতনা করার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একটা আবেগ কাজ করে। খতনা করাতে গিয়ে যদি ডাক্তারের হাতে শিশু মারা যায়, তাহলে তো হাজামই তো ভালো। এমন পদধ্বনি সমাজে শোনা যাচ্ছে। হাজামের হাতে কোনো শিশু মারা গেছে এমন খবর জানা মতে শোনা যায়নি। তাহলে মানুষ যদি হাজামের শরণাপন্ন হয়ে হাতুরে চিকিৎসা নেয়, তাহলে সরকার এতো টাকা খরচ করে কেন মেডিকেল চিকিৎসক তৈরি করছে। সেই প্রশ্ন তো এখন উঠছে। অল্পদিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় দুটি শিশু সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে তারা মারা গেল।

স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ডাক্তারা ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর আর জীবিত হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেনি শিশু দুটি। সুন্নতে খতনা বড় ধরনের কোনো অপারেশন নয়। তাহলে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর শিশু দুটি কেন মারা গেল, সেই প্রশ্নের জবার চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। তবে যারা গ্রাম্য হাজামের কাছে সুন্নতে খতনা করিয়েছেন, তারা কি কোনো ব্যথা পেয়েছিলেন কি না, সেই কথা হয়তো স্মরণ থাকার কথা নয়। কেন না, নিমিষের মধ্যে চাকু দিয়ে বর্ধিত চামড়া কেটে হালকা ব্যান্ডেজ দেয়ার পরই শিশুরা রীতিমতো হাটাহাটি করতে পারে। এখনো রাজধানীর আশপাশের এলাকায় হাজামরা আগের পদ্ধতিতেই সুন্নতে খতনা করান। আহনাফের বাবা ফখরুল আলম জানান, আমরা চিকিৎসককে বলেছিলাম যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। তারপরও আমার ছেলের শরীরে সেটি পুশ করেন ডা. মুক্তাদির। আমি বার বার তাদের হাতে-পায়ে ধরেছি। আমার ছেলেকে যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আমার সন্তানকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই। আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই। অভিযুক্ত চিকিৎসক মুক্তাদির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক বিভাগের জয়েন্ট ব্যথা, বাতব্যথা, প্যারালাইসিস বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা দিতেন। বাংলাদেশ তো আর সব সম্ভবের দেশ হতে পারে না। অপরাধীর বিচার না হলে দেশটা তো পেছনের দিকে ফিরে যাবে। মানুষ সচেতন বলেই সুন্নতে খতনার জন্য আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে। এটা তাদের সচেতনতা বোধের বর্হিপ্রকাশ। এরআগে গত ৮ জানুয়ারি রাজধানীর বাড্ডা সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে লাইফ সাপোর্টে থাকা শিশু আয়ান মারা যায়। টানা সাত দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল আয়ান। মাত্র দেড় মাসের মাথায় আরেকটি শিশু একইভাবে মারা গেল। কীভাবে পুত্র সন্তানের অভিভাবক শিশুদের সুন্নতে খতনা করাবেন তা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা হাজাম যুগে ফিরে যাবেন কি না, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত