স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ

মহিউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ডিজিটাল গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চায়। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চারটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্মার্ট জনগোষ্ঠী তৈরি করা। খাদ্যে আমরা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারলেও একেবারে পিছিয়ে নেই। কিন্তু যে খাবারটি খাচ্ছি সেটি কতটুকু নিরাপদ?

কোরিয়া, জাপান এবং চীনের জনগোষ্ঠী একসময় বেটে প্রকৃতির ছিল। তাদের উচ্চতা কখনো ৫ ফিটের ওপরে ছিল না। কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের উচ্চতা ৬ থেকে ৭ ফিট হয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ তারা আমাদের চেয়ে এখন অনেক বেশি সুষম, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার খাচ্ছে।

তাদের কাজের দক্ষতা এবং ধৈর্য ও মেধা আমাদের চাইতেও বেশি। ওরা তো আমাদের চাইতে অনেক কম খায়। আমরা যে বলি, আমরা ভাতে-মাছে বাঙালি। তিন বেলা পেট ভরে খাই। তাহলে আমরা কেন পারছি না? কারণ হচ্ছে ওরা যা খায় তা আমাদের চাইতে পুষ্টিদায়ক এবং ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাবার। আমরা যে ডিজিটাল ও চতুর্থ পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি, সেখানে আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া, সরবরাহ এবং নজরদারি কতটুকু প্রযুক্তিবান্ধব হলো? হ্যাঁ আমরা কৃষিক্ষেত্রে হয়তো লক্ষ্য করি কৃষকের গরুর হালের বদলে ট্রাক্টর, পানি সেচে প্রক্রিয়া, বীজ বপন ও ধান কাটার ক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে যেভাবে কৃষি, মৎস্য, পশু, ফলমূলসহ খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহে যেভাবে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) ব্যবহার হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের অবস্থা কোথায়?

হাইব্রিড, অধিক ভিটামিন প্রয়োগ কিংবা মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ার কারণে আমাদের উৎপাদন হয়তো কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সেই উৎপাদন খরচ এতটাই ব্যয়বহুল হয়েছে যার ফলে সাধারণ মানুষকে খাদ্য কিনতে আয়ের বেশিরভাগ অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া ঊর্ধ্বগতি জীবনযাত্রাকে স্থবির করে দিয়েছে। দেশে উচ্চমূল্যের খাদ্য সামগ্রী কিনতে নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

বলা হচ্ছে, চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট ব্যবহারের সাথে সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। এখন কৃষকের উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার খাবার টেবিল পর্যন্ত অনেক দেশেই প্রযুক্তির ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি হোটেলে বয়ের কাজ করছে রোবট। আমরা যদি কৃষি জমি, মৎস্য উৎপাদন, এগ্রো ফার্ম, পোল্ট্রি শিল্প এমনকি ফলমূল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করতে সক্ষম হতাম, তাহলে আমাদের জমির উর্বরতা, জমির নিরাপত্তা ও আর্দ্রতা সম্পর্কে অবগত হতে পারতাম।

সেই সাথে কি পরিমাণ বীজ বপন, কীটনাশক প্রয়োগ বা পানির পরিমাণ কতটুকু থাকবে, কি থাকবে না, তারও দেখভাল আমরা এই আইওটি ডিভাইসের মাধ্যমে করতে পারতাম। যার ফলে অতিরিক্ত বীজ ও কীটনাশক এমনকি সেজ খরচ বেঁচে যেত। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ যেমন কমতো, ঠিক একইভাবে খাদ্যের নিরাপত্তা এবং মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা যেত। একইভাবে মৎস্য, পোল্ট্রি ও গবাদি পশুপালনে চতুর্থ প্রজন্মের আইটি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে আমরা আমিষ ও প্রোটিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতাম। আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো জমি থেকে উৎপাদন এবং ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপত্তায় প্রযুক্তিগত শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, যা দুঃখজনক। অথচ চীন, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশেই এখন আইওটি বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি শিল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা আসার পর আমরা কেবলমাত্র ঘরে বসে অনলাইনে খাবার অর্ডার করা ছাড়া বেশি কিছু করতে পারছি না। এর মধ্যে অনলাইনে অর্ডার করা খাবারের ভেজাল মিশ্রণ, ফরমালিন মেশানোর অভিযোগ উঠছে। আমরা সন্ধ্যার সময় লক্ষ্য করি, দেশে ওষুধের দোকানগুলোতে মানুষের লাইন পড়ে যায়। তার মানে যে টাকার খাবার কিনতে হয়, তার সমপরিমাণ টাকার ওষুধ কিনতে হচ্ছে।

ঘরে ঘরে আজ অসুস্থ মানুষ। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য খাদ্যের নিরাপত্তা অপরিহার্য। আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে প্রায় ৩০টি আইন আছে খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য। যদিও যে সকল প্রতিষ্ঠান অনলাইনে খাবার সরবরাহ করছে, তাদের জন্য কোনো নীতিমারা ও নজরদারি নেই। ডিজিটাল যুগে ঘরে বসে খাদ্যের সাথে মানুষ বিষ খাচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করেছি অনলাইনে খাবার সরবরাহ অর্ডার হয়ে থাকে প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। এরমধ্যে বহুজাতিক একটি কোম্পানি একাই বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার খাবার সরবরাহ করে থাকে। দেশের জনগণের আয় ও প্রযুক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে অনলাইনে খাবার অর্ডার দিন দিন বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। ২০২৬ সালে এই বাজার দাঁড়াতে পারে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু অনলাইনে খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে এবং সার্ভিস চার্জ, ওজনে কম দেওয়া, সময়মতো খাবার সরবরাহ না করা, অফারের দেখানো দামের চাইতে অতিরিক্ত দাম নেওয়া, নষ্ট খাবার ফেরত না নেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া অ্যাপে অর্ডার নেওয়ার সময় খাবারের দাম ও ডেলিভারি ফির সাথে অতিরিক্ত প্ল্যাটফর্ম ফ্রি হিসেবে তিন টাকা আদায় সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। গ্রাহকদের কাছে কৌশলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এই সুযোগে অনলাইনে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম, সার্ভিস চার্জ, ওজনে কম দেওয়াসহ মানহীন খাবার সরবরাহ করে আসছে। এতে করে অনলাইনে গ্রাহকদের অতিরিক্ত অর্থের সাথে সাথে স্বাস্থ্যহানী ও জীবন ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। গতবছর গুলশান ২-এ পান্ডা হাউসের স্টোরে ডেলিভারি আউটলেটে অভিযান করে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল খেজুরের ওপর তেলাপোকা চলাফেরা করা, চকলেট, ডিম, মাছের মেয়াদ না থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। অতিরিক্ত দাম নেওয়ার কারণে ভোক্তা অধিদফতর ইতিমধ্যে জরিমানা করেছে ফুড পান্ডাকে। তাছাড়া গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন অসম বাজার প্রতিযোগিতার কারণে এই প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। অন্যদিকে দশ শতাংশ শুল্ক সরকারকে না দেওয়ার অভিযোগও তুলেছে আয়কর বিভাগ।

প্রত্যেক সরকারই চায় তার কৃষক উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পাক, আবার ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে বা ন্যায়সঙ্গত মূল্যে পণ্যটি পেয়ে থাক। কিন্তু মাঝখানে মধ্যসত্বভোগী, মজুতদার, সিন্ডিকেটকারীসহ বহুবিধ কারবারি এর ওপর দাঁড়িয়েছে অসম বাজার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বেশ কিছু প্রভাবশালী গ্রুপ অব কোম্পানি। দিন দিন ভোক্তারা জিম্মি হয়ে পড়ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্যের বিষক্রিয়া ভোক্তা বা নাগরিকদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীকে দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ কীভাবে সম্ভব? জনগোষ্ঠী যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হয় মেধাবী ও দক্ষভাবে গড়ে না ওঠে তাহলে কি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব? মোটেও নয়। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষকের জমি থেকে উৎপাদন পর্যায়ে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটিয়ে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত অনলাইনে সরবরাহ করা গেলে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে। সেই সাথে মজুত করার বা সিন্ডিকেট করার সুযোগটাও নষ্ট হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে নিরাপদ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য কীভাবে ভোক্তার টেবিলে পৌঁছানো যায় সে ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ