ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ই-কমার্স ও ই-সেবা খাতে সম্ভাবনা

মহিউদ্দিন আহমেদ
ই-কমার্স ও ই-সেবা খাতে সম্ভাবনা

২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। এর পরের বছর মুন্সীজী ডট কম নামে একটি সাইট থেকে ই-কমার্স যোগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। আর সরকার যখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেয় সেই, মুহূর্তে বাংলাদেশে ই-কমার্স ও এফ কমার্স উদ্যোক্তার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫ লাখের উপর। বর্তমানে ই-কমার্সের বাংলাদেশের বাজারের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি বর্তমান মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর। এরই মধ্যে বাণিজ্যিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিচার্জ অ্যান্ড মার্কেট ডট কমের মতে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এ মার্কেট হবে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। আমাদের ধারণা মতে এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা করে। অথচ দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এরই মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি। অনলাইনে কেনাকাটার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাত্র ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ কেনাকাটা করছে। অন্যদিকে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবমিলিয়ে এখনো প্রায় ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সেবার বাইরে রয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত করতে পারলে এবং তাদের ভোক্তা স্বার্থরক্ষা করে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে ই-কমার্স খাত হবে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বাণিজ্যিক খ্যাত। তাই এ খাতের উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে প্রান্তিক ভোক্তা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে শুধু আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তাদের সমস্যা সম্ভাবনা ও সংকট নিরসন করে রাষ্ট্রকে তাদের সহযোগিতাও করতে হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করে এই সেবা খাতে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য আমরা আহ্বান জানাই। ই-কমার্স উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রয়োজন একদল আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ-মেধাবী তরুণ জনগোষ্ঠীর। যারা মূলত ই-কমার্স সাইট পরিচালনা করা থেকে শুরু করে ওয়ার হাউস ব্যবস্থাপনা, কল সেন্টার, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট পরিচালনা, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, কাস্টমার হেপিনেস, ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ, মার্কেটিং এক্সিকিউটিভসহ ডাটা কালেক্টর প্রভৃতি কাজে কাজ করবে। তাছাড়া ক্লাউড এবং নিরাপত্তার জন্য ব্লকচেন নিয়েও কাজ করবে অসংখ্য তরুণ প্রযুক্তিবিদ। অর্থাৎ ব্যবসার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রযুক্তিবিদদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে এই খাত।

কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, ই-কমার্সের জয়যাত্রার মাঝখানে গ্রাহকদের অসাবধানতা, প্রশাসনিক নজরদারির অভাব, উদ্যোক্তাদের পলিসিগত ভুল সিদ্ধান্ত ই-কমার্সকে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। বিশেষ করে ইভ্যালি, কিউ কম, ধামাকা শপিং, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, বোম বোম, আদিয়ান মাট, নিউ ডট কমসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম না বললেই নয়।

এ সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ নিয়ে পণ্য না দেওয়া, মানহীন পণ্য দেওয়া, ডেলিভারিতে সময়ক্ষেপণ করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনে এ নিয়ে হাজার হাজার মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেছেন গ্রাহকরা। অনেক উদ্যোক্তাকে এরই মধ্যে কারাবরণ করতে হয়েছে। আবার অনেক উদ্যোক্তা সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছেন গ্রাহকদের কাছ থেকে দায় মুক্তি পেতে। এরই মধ্যে ই-ভ্যালি ঘোষণা দিয়েছেন, তারা গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করবেন। তাদের এ ধরনের সাহসী উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। অন্য উদ্যোক্তাদের কেউ এভাবে গ্রাহকের পাশে দাঁড়ানোর আমরা আহ্বান জানাই। কিন্তু তার আগামী দিনে কতটা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করবেন, সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার করার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন নজরদারি থাকা আবশ্যক বলে মনে করি।

ই-কমার্স খাতে নৈরাজ্যের পর সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন তাও দেখার বিষয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসাপদ্ধতি জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সুরক্ষা এবং ডিজিটাল কমার্স খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না, সেটাও জানতে চাওয়া হয়। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের মোট সম্পদ ও দেনার পরিমাণ সেইসঙ্গে কতজন গ্রাহকের কি পরিমাণ টাকা আটকে আছে সে বিষয়ে জানিয়েছে। ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসাপদ্ধতি এবং কীভাবে তারা তাদের দেনা পরিশোধ করবে, সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। সেটার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ) অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও প্রচুর অভিযোগ জমা পড়েছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের কার্ডের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। পণ্য সরবরাহকারী বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও এখন এসব কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এতকিছুর পর আমরা কি এই সম্ভাবনাময় এই খাত বন্ধ করে দেব? মোটেও তা নয়, আমরা এই সেবা ও সম্ভাবনামায় খাতকে কীভাবে সংকটের বাইরে থেকে ভোক্তা এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তামূলক করা যায় তা করব। কীভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এটি গড়ে তোলা যায়, সেদিকে সবাইকে এগিয়ে আসার আসতে হবে। যারা সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছেন আমরা তাদের স্বাগত জানাই। এছাড়াও বেশ কিছু প্রতারক চক্র রয়েছে যাদের আমরা সহজেই কাছে ধরতে পারছি না, যারা প্রতারণা করে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তাদের অনলাইন সাইট বন্ধ করে আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমাদের অনুরোধ রইল। তাছাড়া কিছু কিছু বিদেশি এবং দেশীয় ই-কমার্স সাইডে প্রকাশ্যে যৌন পণ্য, মাদক, অস্ত্রসহ আমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মবিরোধী পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। এ সব সাইট বন্ধ করতে বিটিআরসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং ই-কমার্স সেবা খাতে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান ই-ক্যাবের প্রতি আমাদের অনুরোধ রইল।

ই-সেবা খাত : সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সব সেবা খাতের পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি সব সেবা খাতেই এখন ই-সেবায় পরিণত হয়েছে। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-পাসপোর্ট, ই- রেজিস্ট্রেশন, ই-ট্রেড লাইসেন্স, ই-বিলিং সিস্টেম, অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল প্রদান, ভ্রমণ, হজ ব্যবস্থাপনা, ই-টেন্ডার, ই-নাম জারিসহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি সেবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং, এটিএম বুথ সেবা, ডিজিটাল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, সড়কের টুল পরিশোধের জন্য ই-টুল ব্যবস্থা, গণপরিবহনে ই-টিকেটিং, অনলাইনে রেলের টিকিট কাটা, অনলাইনে ফুড ডেলিভারি, ই-কুরিয়ার, সড়কে পাঠাও, উবারসহ অসংখ্য ই-সেবা খাত সচল রয়েছে। একইসঙ্গে এসব সেবা খাতে প্রতারণা বহু মাত্রার বৃদ্ধি পেয়েছে।

ই-সেবা খাতে নৈরাজ্য প্রতিরোধ এবং ই-কমার্সকে শৃঙ্খলাতে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা অনুরোধ করব যে, আপনারা বিল্ডিং সিস্টেমের জন্য সার্ভিস চালু করতে পারেন কি না এবং ভোক্তা অধিদপ্তরে আলাদা একটি অভিযোগ গ্রহণের জন্য অনলাইন ডিজিটাল সেল বা আলাদা একটি হট লাইন চালু করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে।

পরিশেষে আমরা ভোক্তা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ করব যে, গ্রাহক সচেতনতায় ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম শুরু করার। সেই সঙ্গে ভালো উদ্যোক্তাদের সমস্যা ও সংকট সমাধান করে তাদের পাশে থাকার জন্য। ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা আসলে রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান, নতুন নতুন বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়ে একটি স্মার্ট অর্থনীতির ভিত্তি রচিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত