ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর

অবশেষে কি হবে সেটাই ভাবিয়ে তুলছে বিশ্বকে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর

ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসনের দুই বছর আজ। রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই আক্রমণটিকে আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে। ৮৮ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও লক্ষাধিক মানুষ। দুটি বছর কম সময় নয়। তবে যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে তা যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মতো ছিল না। রণাঙ্গনে রাশিয়ার মতো একটি পরাশক্তির কাছে ইউক্রেনের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের টিকে থাকা কতটা কঠিন এখন দেশটির জনগণ বুঝতে পারছে। বিশ্বের যেসব দেশ ইউক্রেনকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা করার প্রতিশ্রতি দিয়েছিল তারাও পিছিয়ে এসেছে। ফলে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো রণাঙ্গনে রুশ সৈন্যরা পিছু হটে যাচ্ছে। এতে করে ইউক্রেনের সৈন্যরা উজ্জীবিত হলেও সেটা খুব সাময়িক। কেননা বাইরের দেশ থেকে কিয়েভ তেমন কেনো সামরিক সহায়তা পাচ্ছে না। তাহলে কি হবে। রুশ সেন্যদের কাছে ইউক্রেনের পতন হবে কি না আর পতন হলে সে দেশর ভাগ্যে কি হবে তা নিয়ে মানুষ ভাবছে। ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান একটি বিশ্লেষণ করেছে। এতে বলা হয়েছে, আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গত প্রায় নয় মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউক্রেন জয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছে রাশিয়া। বিপরীতে কিয়েভের মনোবলে ফাটল ধরেছে। কী ঘটবে আগামী দিনগুলোতে সেই চিন্তাই এখন করছে বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ। ইতোমধ্যে ইউক্রেনে গোলাবারুদের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত নভেম্বরে মাসে ইউক্রেনের সৈন্যরা প্রতি দশ দিনে অন্তত ৩০০ শেল সরবরাহ পেত। ফলে প্রতিমুহূর্তে গুলি চালানো যেত। আর এখন তারা দিনে ১০টি গুলি চালাতে পারে। তাও শুধু প্রতিরক্ষার জন্য। গোলাবারুদের সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি যেগুলো আছে সেগুলো ইরানের তৈরি, যা হুথিরা উপসাগরে জাহাজ আক্রমণের কাজে ব্যবহার করে। প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যবহার করার মতো নয়। কেননা সেগুলো নিম্নমানের। কিয়েভের সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ নাটালিয়া ক্রাইভদা অবশ্য আভদিভকার এই পতনের জন্য ইউক্রেনের জাতীয় ঐক্যের অভাবকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রহীন জাতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাই তখন মানুষ দায়িত্ব নিয়েছিল। তারা আদেশের অপেক্ষা করেনি। বরং যুদ্ধের প্রথম বছরে শক্তিশালী নতুন ইউক্রেনীয় পরিচয় তৈরি করতে প্রাণপণ লড়াই করেছে। কিন্তু সেই ঐক্যে এখন ফাটল ধরতে শুরু করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত শনিবার, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশটির জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, গত দুই বছরে ইউক্রেনীয়রা কতটা অর্জন করেছিল। দুই বছর মানে ৭২৪ দিন। এই সময়ে ইউক্রেন জয় না পেলেও হেরে যায়নি। কিন্তু যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকা এবং সামরিক সরবরাহ কমে, মার্কিন আর্থিক সহায়তা স্থগিত ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগামীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনায় ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সে দেশর মানুষসহ পশ্চিমারা। ফলে ইউক্রেনে স্পষ্টতই দেখা দিয়েছে বিভাজন। যুদ্ধের এই পর্যায়ে, স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যাবে এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী বিজয়ী হতে পারে এবং দ্রুত সব হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে তাদের কাছে মনে হচ্ছে না। কিয়েভ গত বছর থেকেই স্বেচ্ছাসেবী সেনা সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে নামও লেখাচ্ছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, যুদ্ধে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই লুকিয়ে থাকছে বা পালিয়ে বেড়াচ্ছে বা অন্য দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। কিয়েভের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেনকো বলেছেন, এ সময় আমাদের সংহতি প্রয়োজন। একেবারে সেনা সংগ্রহ না করে ধাপে ধাপে তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এদিকে নতুন নিয়োগ পাওয়া সেনারা কতটা ভালোভাবে যুদ্ধ করতে পারবে সেই প্রশ্নও রয়েছে। সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণের সময়কাল এক মাস থেকে বাড়িয়ে দুই মাস করার পরিকল্পনা চলছে, তবে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য এটিও খুব পর্যাপ্ত সময় নয়। আর্টিলারি ডিভিশনের ডেপুটি কমান্ডার ভ্যালেন্টিন বলেছেন, মানুষের আসলে বাড়ি এবং প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। মৃত্যুভয় তো আছেই। তবে এতোসবের মাঝেও কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। নৌবাহিনী না থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণসাগরে আধিপত্য বাজায় রেখেছে ইউক্রেন। এখনও যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়েনি তারা। দেশে ড্রোন তৈরির কাজও চলছে। যদিও এগুলো যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে না। কারণ যুদ্ধের তৃতীয় বছরে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটও ভেঙে যেতে পারে। প্রথম বছরের ঐক্য এখন আর নেই। জেলেনস্কির রাজনৈতিক বিরোধীরা ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে। এই মাসের শুরুর দিকে জনপ্রিয় সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্তের বিষয়টিও ইউক্রেনের ঐক্যের ঘাটতিকে তুলে ধরেছে। এই বসন্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। তবে উদ্বেগ রয়েছে যে জেলেনস্কি জাতীয় ঐক্য হারাতে পারেন। যদিও ইউক্রেনিয়রা বুঝতে পারছে যে, তাদের অভ্যন্তরীণ অশান্তি কেবল রাশিয়াকেই বিজয়ী করে তুলবে। তারপরও যুদ্ধের তৃতীয় বছরটি ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে কঠিন হতে পারে। কারণ যুদ্ধের প্রথম বছরে পশ্চিমারা ভাবতে পারেনি যে, ইউক্রেন রাশিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু তবুও তারা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে। দুই বছর আগে রাশিয়া আক্রমণ চালালে, খুব সামান্যই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতো। কিন্তু এখন এটা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য লড়াই করাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির কথাও ভাবা হচ্ছে। ফেসেনকো বলেছেন, যদি আমরা পরের বছরটিকে থাকতে পারি, তাহলে সম্ভবত এক ধরনের যুদ্ধবিরতির আলোচনা করতে বাধ্য হবো। কিন্তু এখানেও কিছু কথা রয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের সম্পূর্ণ পরাজয় এখনও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এক অসম্ভব স্বপ্নই বটে। কারণ এর আগেও রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছিল। আর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সঙ্গে ‘মিনস্ক শান্তিচুক্তি’ করেছিল। মূলত ওই চুক্তির ফলেই ৮ বছরের জন্য যুদ্ধ থেমে ছিল। কিন্তু রাশিয়া সেই চুক্তি ভঙ্গ করে ইউক্রেন আক্রমণ করে। কিন্তু আবারও যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে, রাশিয়া যে আবারও ইউক্রেন আক্রমণ করবে না, তার কোনও বিশ্বাস নেই। কেননা শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে যাওয়ার পর, আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসা কঠিন। মস্কো তার কথা রাখবে, সেটা এখন আর কোনো ইউক্রেনীয় নাগরিকই বিশ্বাস করে না। তাহলে পরিস্থিতি কোথায় যাবে সেই ভাবনা এখন বিশ্ববাসির। সবার কামনা রাশিয়া ও ইউক্রেনের নেতাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। মানুষের কল্যাণে তারা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত