বাঁশ নিয়ে একটি অর্থকরি আলোচনা

এস এম মুকুল

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাঁশকে বলা হয় মিরাকল প্ল্যান্ট। কারণ এর রয়েছে প্রভূত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে বিপুল পরিমাণ আয় ও কর্মসংস্থান করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করে পৃথিবীর অনেক দেশই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বাঁশের চারা উৎপাদন করার ফলে একর ২০ টন পর্যন্ত বাঁশ আহরণ সম্ভব হচ্ছে। বাঁশের মণ্ড কাগজ তৈরির জন্য বিখ্যাত এ কথা সকলেরই জানা। নতুন খবর হচ্ছে ইদানিং বাঁশের মণ্ড থেকে বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যথা তুলা ও সুতা তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও বাঁশ সংশ্লিষ্ট শিল্প গড়ে উঠছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে বাঁশ দিয়ে প্লাইবোর্ড, পার্টিকেল বোর্ড, সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ডসহ গৃহস্থালির আসবাবপত্র তৈরি করা হচ্ছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিনের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কাটিং পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে বাঁশ চাষে ব্যাপক সাফল্য ও সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। ৪০টি বাঁশ উৎপাদনকারী দেশের সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর ব্যাম্বু অ্যান্ড র‌্যাট্টান বলেছে- বাঁশ গাছ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়া রোধে সহায়তা করতে পারে। বাঁশ গাছের শিকড় মাটি ক্ষয়ে যাওয়া রোধ করতে পারে। বাঁশ দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। বাঁশের পাতা পড়ার পর তা মাটির সাথে মিশে গিয়ে মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে। চীনে বহুবছর ধরে বাঁশ উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাওয়া জমির পুনরুজ্জীবনে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঁশের সাহায্যে ভারতের এলাহাবাদে ইটের ভাটার কারণে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর জমি পুনরুজ্জীবন করা হয়েছে, যাতে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি মানুষ উপকৃত হয়েছেন। তারমানে বাঁশ অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই আমাদের বেশি বেশি বাঁশ লাগানো উচিত। কৃষকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ উৎসাহিত করা এবং আসবাবপত্রসহ নান্দনিক শিল্পে বাঁশের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবতে পারেন সরকার। তাই বাঁশ বলিয়া বাঁশকে যতই হেলা করেন না কেন- বাঁশ উচ্চ মাত্রার ভেলু এডেড প্রোডাক্ট হিসাবে বিবেচিত হতে যাচ্ছে হয়তোবা। কারণ, বাঁশ দিয়ে তৈরি ভবন অতি ভূমিকম্প সহনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বাঁশ হতে খুবই শক্তিশালী ও উন্নতমানের রড তৈরি করছে জাপানিরা। তারা বাঁশের তৈরি রড ব্যবহার করে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় বাঁশের ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া শক্তিশালী ব্যামবো রড এখন মাছ ধরার ছিপ তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আসুন বাঁশ নিয়ে বেঁশেল কথা বাদ দিয়ে বরং অর্থকরি বিষয়ে আলোচনা করি। বাঁশ ও বেতের চাষ বেশি হয় সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বাঁশ এমন এক উদ্ভিজ যার রোপণ একবার আহরণ বার বার। তথ্য-তালাশে জানা গেছে, বিশ্বে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মূলী, মিতিয়া, ছড়ি, আইক্কা, বাইজা, বররা, মাকাল, বড়বাঁশা, মাতলা তল্ল্যা, উড়া, কাঞ্চন, মুলাই, করমজাসহ প্রায় ২৬ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। মৌলভিবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ এলাকায় জন্মে দেশের সবচেয়ে বড় ও লম্বা প্রজাতীর বাঁশ। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের শালবলে জন্মে ছোট ছোট নলীবাঁশ, যা ঘরের সিলিং এবং বাঁশী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাঁশ সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা গেল- বাঁশ ও বেতের ফার্নিচারের প্রচলন প্রথম শুরু হয় সিঙ্গাপুর এবং ভারতে। ভারত থেকে এর প্রচলন শুর হয় আমাদের দেশে সিলেট অঞ্চলে। আসাম, ত্রিপুরা, কলকাতা থেকে বাঙালিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে মবেত শিল্পের সূচনা ঘটায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কুটির শিল্পে বাঁশের নান্দনিক ব্যবহার নজর কাড়ে শহরবাসীর। বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে- মাদুর, চাটাই, হাত পাখা, ঝুরী, ধানের ডোলা, কোলা, আসবাবপত্র, খেলনা ঘর, খাট পালংক আরামদায়ক বিছানা, মূর্তি ও ভাস্কর্য কতকিছু। এসব আবার দেশে-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে শৈল্পিক নান্দনিকার কারণে। জানা না থাকলে জেনে রাখুন- বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ বাঁশের তৈরি ঘরে বাস করে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর ক্ষেত্রে বাঁশ অদ্বিতীয়। কারণ বাঁশ অন্য সব গাছপালার চেয়ে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং অন্য উদ্ভিদের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। টমাস আলভা এডিসন প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে বাঁশের ফিলামেন্ট ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই বাল্বের একটি এখনোও ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ১৮৭৯ সালে এডিসন উদ্ভাবিত বাল্বের কারবরানাইজড ব্যামবো ফিলামেন্ট ১২০০ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্বলতে সক্ষম ছিল। শুনে অবাক হবেন- বাঁশ মানুষের জন্য পুষ্টিও যোগায়। খাদ্যগুণ ও স্বাদের কারণে চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বাঁশ ভেজিটেবল হিসাবে সমাদৃত। কচি বাঁশের নরম কাণ্ড এশিয়ায় খাওয়ার প্রচলন আছে। কচি বাঁশের ডগা মুখরোচক সবজি- এতে আছে জার্মেনিয়াম, যা কোষের বয়োবৃদ্ধি রোধে সহায়তা করে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বর্ষার মৌসুমে কচি বাঁশের ডগা খেয়ে থাকে। আমাদের গ্রাম বাংলায় নিরাপদ গৃহ নির্মাণে বাঁশ অনন্য ভূমিকায়। আমাদের সাহিত্য বা গণিত উভয় শাখায় রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। তেলমাখা বাঁশ নিয়ে অংক করতে গিয়ে ছাত্রজীবনে কম মাথা ঘামাতে হয়নি। আবার বাঁশির সূত্রধরে রাধা-কৃষ্ণের অমর প্রেমকাহিনির সঙ্গে রয়েছে বাঁশের সম্পৃক্ততা। সেই গানটির কথা তো সবাই জানেন- ‘বাঁশির সুরে কাজ নাই, সে যে ডা-কাণ্ডতি-য়া বাঁশি’। অন্যদিকে দেশপ্রেমের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের ইতিহাসের পাতাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে ‘তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা’। গ্রামবাংলায় বাঁশ দিয়ে লাঠিখেলা নামের একটি স্বাস্থ্যসম্মত খেলার প্রচলন প্রাগৈতিহাসিক। বাঁশ নিয়ে একটা প্রাচীন প্রাদ আছে- ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাসঠাস’ অথবা ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’। প্রবচন দুটির অর্থ সবারই জানা আছে। আমাদের পল্লী কবি জসিম উদ্দীন নকশী কাথায় বাঁশ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘ওগা’র বাঁশ দশটা টাকায়, সে গায় টাকায় তেরো/মধ্যে আছে জলির বিল কিইবা তাহে গেরো/বাঁশ কাটতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিড়া/ দুপুর বেলায় খায় যেন সে মায় দিয়েছে কিরা।’ আহারে, যতিন্দ্রমোহন বাগচির কবিতায়- ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শুলক বলা কাজলা দিদি কই’- এই পঙিক্তমালায় কি যেন মায়ার জাদু মিশে আছে। কথায় এবং কর্মে বাঁশ দেয়ার প্রবণতা বাঙালির বহু পুরোনো অভ্যেস। প্রতিহিংসাকাতর হয়ে কিংবা ঘায়েল করার জন্য বাঙালিরা প্রতিপক্ষকে সহসাই বাঁশ নামক বস্তুটি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাঁশ সবসময় শুধু জিদ্দির প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়, যে তা কিন্তু নয়। মানুষের জীবনে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার লক্ষণীয়। বাঙালির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশের ব্যবহার যেন সৃষ্টির অমীয় বিধান। আগেরকালে জন্মের পর বাঁশের চাছি দিয়ে নাড়ি কাটা হতো। আর মৃত্যুর পর বাঁশের খাটিয়ায় শেষযাত্রা চিরন্তর সাক্ষী। মানব জীবন শেষে কবরেও বাঁশকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। রসিকতা করে বলা যেতে পারে, এ মানব জীবন কোনোভাবেই বাঁশমুক্ত নয়। আমরা সাধারণ আমজনতারা সবচেয়ে বেশি বাঁশ নামক বস্তুটি খেয়ে থাকি- রাজনীতিবিদদের দ্বারা। আমরা ভালোবেসে যাদের ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানাই- তারাই নির্বাচিত হয়ে আমাদের ক্রমাগতভাবে বাঁশ দিয়ে যেতে থাকেন। জনৈক নেতা এক জনসভায় বলেছিলেন- ‘আমি যদি নির্বাচনে জিতি তাহলে আমি আপনাদের জনে জনে বাঁশ দিব।’ বাংলার গ্রামীণ জনপদে খাল, নদী এবং নালা পারাপারের জন্য বাঁশের সাকু’র ব্যবহার সুপ্রাচীনকালের হলেও জননেতারা জনগণের উন্নয়নের জন্য রডের পরিবের্তে বাঁশের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন- রাস্তা, ব্রিজ ও অবকাঠামো নির্মাণে। মেধাহীন মানুষের কাছে বাঁশের মূল্য তুচ্ছ হতে পারে অথবা মানুষকে অকাতরে বাঁশ দেয়ার মাঝে নিহিত থাকতে পারে। তবে চিরসত্য কথা মানব জীবনের বাঁশ অমীয় সঙ্গী হয়েছিল, আছে, থাকবে। বাঁশ দিয়ে শৈল্পিক সৃষ্টিতে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন, তাইওয়ানে প্রচুর শিল্প গড়ে উঠেছে। রাজপ্রসাদ, দামি ভিলা, রেস্টুরেন্ট, পাঁচতারা হোটেলগুলোর অভ্যন্তর ভাগ সাজাতে বাঁশের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলছে। বাঁশের পাতার ঝুপরির ফাঁকে ফাঁকে ঘুঘু, বুলবুলি, টুনটুনি বাসা বাঁধে। বাঁশ বাংলাদেশে জ্বালানি লাকড়ি হিসেবে অধিক ব্যবহৃত। নিত্য ব্যবহার্যসামগ্রী, ঘর সাজানোর বস্তু, বৈদ্যুতিক বাতি নির্মাণে, ফটো ফ্রেম তৈরিতে বাঁশের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাঁশের বহুমাত্রিক ব্যবহার ইতিবাচক হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঁশের ব্যবহার চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। যেমন- গাইবান্ধায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনায় নির্মাণাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৫ তলা ভবনের কংক্রিট ভেঙে রডের বদলে বাঁশের অস্তিত্ব বেরিয়ে আসে। সিলেট-আখাউড়া রেলপথের কুলাউড়া উপজেলার ২০৬ নং মনু রেল সেতুর নষ্ট হওয়া স্লিপারের সংস্কার কাজে লাগানো হয়েছে বাঁশ। এমনকি পিচঢালা রাস্তা ও ব্রিজে রডের পরিবর্তে বাঁশের জায়গা করে নেওয়ার খবর জনমনে রসিকতার সৃষ্টি করাটাই যেন স্বাভাবিক।