শবেবরাতের তাৎপর্য ও ফজিলত

রাতটি কাটবে নফল এবাদতের মধ্যদিয়ে

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ পবিত্র শবেবরাত। আজকের রাতটি অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ ও মহিমান্তিত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবেবরাতের আরবি হলো- ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও পারস্যসহ বিশ্বের অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষায় উপলক্ষ্যটি ‘শবেবরাত’ নামেই অধিক পরিচিত। হাদিস শরিফে আছে, ‘হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আয়শা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’

হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেন না, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। এ ছাড়া প্রতি মাসের ৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরো বেশি রাখতেন।

এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনরা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। ইবাদতের পাশাপাশি শবেবরাত উপলক্ষ্যে হালুয়া-রুটি খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে অনেকের মধ্যে। তবে এটি ইসলামি বিধানসম্মত কোনো বিষয় নয়। নবীজি কিংবা সাহাবিদের যুগে শবেবরাত বা লাইলাতুম মিন নিসফি শাবানকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটি খাওয়া বা প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলানোর কোনো প্রচলন ছিল বলে হাদিসে পাওয়া যায়নি। পবিত্র শবেবরাতের সঙ্গে হালুয়া-রুটির সম্পর্ক কি এমন বিতর্ক দীঘদিনের। শবেবরাত ও হালুয়া-রুটির পক্ষে-বিপক্ষে দুটি মতামত উঠে আসছে।

তবে যারা বিপক্ষে তাদের ঘরেও গোপনে গোপনে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দাদি-নানিরা শবেবরাতে দিনে চালের রুটি ও হালুয়া তৈরি করতেন। হালুয়া-রুটি প্রচলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে বাঙালির আর্থসামাজিক অবস্থা। দুই ঈদ ছাড়া একসঙ্গে খাবার বিলি করার ঘটনা শুধু শবেবরাতের দিন ঘটে। গ্রামগঞ্জেও এখন চালের রুটি কিংবা সেমাই অথবা হালুয়া তৈরি করা অত্যন্ত শ্রম সাধ্য একটি কাজ। এতো জনবল আমাদের পরিবারে নেই। আর রুটি-হালুয়া তৈরি করার কৌশল কয়জন নারী জানেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফকির-মিশকিন একদিনে এতোসব রুটি খেয়ে শেষ করতে পারে না। তারা অতিরিক্ত রুটি শুকিয়ে পরে খাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। ফলে সেগুলোর পুষ্টিমান ও খাওয়ার উপযোগিতা থাকে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। শবেবরাত উপলক্ষ্যে চিনি, সুজি, দুধ, গরম মশলা, কিচমিচের বেচাকেনা বেড়ে যায়। ফলে অথনৈতিক ক্ষেত্রেও শবেবরাতের একটি গুরুত্ব রয়েছে। তবে শবেবরাতের রাতে একশ্রেণির কিশোর আতজবাজি পোড়ায়। পুলিশ আতজবাজির পোড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও অনেকে তা মানে না। আবার অনেক কিশোর শবেবরাতে রাতে ভ্যান কিংবা রিকশায় করে সারা রাতে ঘুরে বেড়ায়। করবস্থানে যায়। রাতভর হৈইহুল্লো করে।

সকালে বাসায় ফেরার আগে হয়তো ফজরের নামাজ মসজিদ কিংবা ঘরে গিয়েও পড়ে না। শবেররাতে রাতে আমাদের পরিবারের ছোট ছোট সদস্য অভিভাবকদের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। পাশের অভিভাবক যা করেন তারাও তাই করে। কে কয় রাকাত নামাজ পড়ল, সেই হিসাব পরের দিন দেয়। শবেবরাত উপলক্ষ্যে মানুষের মধ্যে একটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং মানুষ আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে।