ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বপ্নের ইউরোপ, দুঃস্বপ্নের ভূমধ্যসাগর

অলোক আচার্য
স্বপ্নের ইউরোপ, দুঃস্বপ্নের ভূমধ্যসাগর

দক্ষিণ এশিয়া এবং দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের কাছে ইউরোপ স্বপ্নের নাম। আর এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়। সেখানেই সলিল সমাধি হয় অনেকের। বাংলাদেশিরাও এর মধ্যে রয়েছে। উন্নত স্বপ্নের আশা দিয়ে তাদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। মানব পাচার সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সমস্যা। উন্নত দেশে উন্নত স্বপ্নের পথে অনিশ্চিত যাত্রা করে তারা। সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে তারা দালালের আশ্রয় নেয়। একসময় সেই দালাল চক্রের সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

মোটা অংকের টাকা দিয়ে কারও কারও মুক্তি মেলে। মাঝেমধ্যেই সেসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আবার কখনো যাত্রায় স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে তীব্র ঠান্ডায় বা খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে আমাদের দেশের নাগরিকও থাকে। এক উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর এসব তরুণ অজান্তেই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরই ১৩ হাজার বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি গেছেন। তার আগের বছর ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন প্রায় ১৫ হাজার। কয়েকদিন আগেও ভূমধ্যসাগরে প্রাণহানির খবর এসেছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকায় আগুন লেগে মারা যান ৮ বাংলাদেশি। ভূমাধ্যসাগর দিয়ে ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রবেশের সংখ্যাই বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫১ জন ইতালির উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। এ সময় নিখোঁজ বা মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৯৭টি। এদের মধ্যে বাংলাদেশি আছেন ১২ হাজার ৭৭৪ জন। ২০২২ সালে সমুদ্র পথে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেছেন ১৪ হাজার ৯৭১ জন বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের ইতালি প্রবেশের রুট বা পথ মূলত ভূমধ্যসাগর দিয়েই বেশি। যারা ইতালির পথে যাওয়ার চেষ্টা করেন সেইসব দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। অভিবাসন সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশস (আইওএম) এক তথ্যে জানায়, ২০১৪ সাথ থেকে ২০২৩ সালের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত- ৯ বছরে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫২ হাজার ৬৭ অভিবাসনপ্রত্যাশী। এর অধিকাংশই সাগরে ডুবে মারা যায়। এ কারণে অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। সেখানে আরো বলা হয়, ৫২ হাজার ৬৭ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে ২৫ হাজার ৩৮৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে ভৌগলিকভাবে এশিয়া ও ইউরোপকে বিচ্ছিন্ন করা ভূমধ্যসাগরে ডুবে। অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে প্রায়ই ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে উন্নত স্বপ্নের আশায় পাড়ি জমাতে আগ্রহী মানুষের করুণ পরিণতির কথা শুনতে পাই। কোনো সমুদ্রের অথৈ জলে অথবা কোনো গহিন অরণ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় তারা। এতকিছু স্বীকার করার পর কারও ঠাঁই হয় সেসব দেশে আবার কেউ দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষা করে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও দেশান্তরী হওয়ার এই মারণ নেশা কেন চেপে বসছে, তার সঠিক কারণ বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি। কারণ আমাদের দেশ অর্থনীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। যখন আমরা স্বপ্ন দেখছি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া, তখন কেন অন্য কোনো দেশে নিজের স্বপ্ন বুনতে হবে আমাদের তরুণদের। বিদেশটা আসলে কোনো মরিচীকার মতো টানছে। বিষয়টা এমন যে, সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম হলেই জীবনের সব ক্লান্তি মুছে যাবে। নিশ্চিত জীবনের আশা বাস্তবায়িত হবে। অর্থ উপার্জন করা যাবে। বিলাসবহুল না হলেও ভালো জীবনযাপন করা সম্ভব হবে। স্বপ্নগুলো মোটামোটি এরকমই হয়। সেই স্বপ্ন এদেশে থেকে পূরণ করা সম্ভব নয় কেন? এই মোহে তারা দেশি ও আন্তর্জাতিক দালাল চক্রের হাতে পরছে এবং করুণ পরিণতি ভোগ করছে। এ অনিশ্চিত যাত্রায় বিদেশের স্বপ্ন দেখা তরুণরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে। তারপরও তাদের অনেকেরই করুণ পরিণতি এমনকি মৃত্যুও বরণ করতে হয়।

এত অর্থ ব্যয় করে বিদেশে অবৈধ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা না করে যদি নিজ দেশেই মেধা খাটিয়ে পরিশ্রম করে কিছু করা যায়, তাহলে সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব। অবৈধপথে বিদেশে উন্নত জীবনের লোভ যারা দেখায় তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উন্নত দেশে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো কর্মসংস্থান। পড়ালেখা শেষে কর্মের নিশ্চয়তা অথবা অল্পশিক্ষিত মানুষের চোখে যদি সম্মানজনক কর্মসংস্থানের দোদুল্যমান অবস্থা সৃষ্টি হয়, তাহলে সহজেই অবৈধপতে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভ্রান্ত হতে পারে। আমাদের সমাজ এমনভাবে তৈরি যেন কোনো বেকারকে কাজে উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে তাকে নিয়ে তামাশা করতেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়, যখন শিক্ষা জীবন শেষ করার পরেও সেই তরুণ কোনো চাকরি বা অন্য কোনো কর্মসংস্থানে না জড়ায়। এভাবে তার মানসিকতা যখন দুর্বল হয়ে যায়, তখন খুব সহজেই তাকে প্রলোভিত করা যায়। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো যায়। অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি দিয়ে যারা সেই স্বপ্ন দেখে, তাদের পরিণতি হয় ভয়ংকর। ভালো চাকরির আশায় দালালের হাত ধরে তাদের যাত্রা শুরু হয়।

মূলত ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দালালের হাতে দিয়ে দেয়। তাদের গন্তব্য হয়তো উন্নত কোনো দেশ। তারা এক হাত থেকে আরেক হাতে, এক চক্রের কাছ থেকে আরেক চক্রের কাছে বিক্রি হয়। বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে কেউ তার গন্তব্যে পৌঁছায়, কেউ মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকে, আবার কারও ঠিকানা হয় জেলে। লিবিয়া হলো- ইউরোপ পাচারকারীদের ট্রানজিট পয়েন্ট। দেশের বিভিন্ন জেলায় মানব পাচারকারীর চক্র ছড়িয়ে রয়েছে। কারা অবৈধ অভিবাসী হয়ে দেশের বাইরে পারি জমাতে চায়? উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর, ভাগ্যাহত যুবক-যুবতী দালালের মাধ্যমে মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রলোভনের শিকার হয়।

ভাগ্যাহত যুবক-যুবতীদের বিশ্বাসকে পুঁজি করেই মানব পাচারকারীরা তাদের এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সিকিউরিটি ডিভিশনের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং এর ২০২৩-২৫ সালের কর্মপরিকল্পনার হালনাগাদ প্রতিবেদনে গত ৩১ ডিসেম্বর জানানো হয়, দেশের তিনটি জেলা মানব পাচারের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। জেলা তিনটি হচ্ছে- কক্সবাজার, ময়মনসিংহ এবং যশোর। মাদক ও অপরাধবিষয়ক জাতিসংঘের কার্যালয় (ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম) তাদের ২০২০ সালের গ্লোবাল রিপোর্ট অন ট্রাফিকিং এ জানায়, অর্থনৈতিক চাহিদার কারণে বাংলাদেশ মানবপাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে এবং ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে দরিদ্র্যের হার প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস করেছে, এরপরও গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক লোক সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ ও দরিদ্র সীমার ভেতরেই রয়ে গেছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আয় উপার্জনের ভালো সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের পাচারকারীরা প্রলুদ্ধ করে। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, একজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শুধু তার স্বপ্নেরই মৃত্যু ঘটে না বরং তার সঙ্গে জড়িত বা নির্ভর একাধিক মানুষের স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। এজন্যই স্বপ্ন দেখতে হবে নিজের দেশকে ঘিরেই। নিজেও দেশকে কিছু দিতে হবে, দেশের কাছ থেকেও নিতে হবে। আর অবৈধ পথে তো যাওয়ার চিন্তা বাদ দিতেই হবে। যদিও এক্ষেত্রে দালাল চক্র সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ। এরাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখায়। আর মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতায় সেই লোভের ফাঁদে পা দেয়। এর ফলে তাদের অর্থ ও জীবন দুটোই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পরে। যে টাকা তারা খরচ করে, সেই টাকা দিয়ে নিজের দেশেই অনায়াসেই কিছু করা এবং জীবন যাপন করা সম্ভব। তবে ইউরোপের স্বপ্নই তাদের চোখে থাকে। তাই এই দালাল চক্র থেকে সাবধানে থাকতে হবে। স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে তা দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। এখান থেকে ফেরাতে হবে, ফিরতে হবে। আইনের পাশাপাশি সচেনতাও বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত