ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবনমান উন্নয়নে নাব্য সংকট কাটিয়ে ওঠা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার
জীবনমান উন্নয়নে নাব্য সংকট কাটিয়ে ওঠা জরুরি

আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। খাল বিল, নদী, হাওরে ভরপুর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনের অবসান ঘটার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগের বৃহৎ মাধ্যম ছিল নৌপথ। দুই দশক আগেও মানুষ বর্ষাকালে নৌপথ দিয়ে দূরের হাটবাজার ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। সেই সময়েও নদী-খালগুলোর গভীরতা ছিল ছোট-বড় নৌকা, ট্রলার চলাচলের জন্য যথেষ্ট, নদীগুলোও স্বরূপ ধরে রেখেছিল। কিন্তু সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকায় মানুষ সড়ক পথে যাতায়াত শুরু করায় এবং নৌপথে চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ধীরে ধীরে নৌপথ তার প্রাণ হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে নদীমাতৃক দেশ তার স্বাভাবিক রূপ হারিয়ে ফেলছে। অযত্ন অবহেলা আর দখল দূষণে বিপন্ন দেশের নদ-নদী। এরইমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক নদ-নদী। খননের অভাবে দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীতে এখন ধু ধু বালুচর। নাব্যতার অভাবে নদীগুলো হারাচ্ছে অস্তিত্ব, বন্ধ হচ্ছে দীর্ঘকালের নৌপথ। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। অন্য একটি সূত্র বলছে, দেশের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার নৌপথে এখন আর সহজে লঞ্চণ্ডস্টিমার চলার মতো পানি নেই। দেশের ৩১০ নদীর মধ্যে বেশির ভাগই এখন নাব্যতা সঙ্কটে ভুগছে। এর মধ্যে ১৭৭টি নদ-নদী বর্তমানে অস্তিত্বের সঙ্কটে। এসব নদ-নদী আংশিক কিংবা পুরোপুরিভাবে মৃত। শীর্ণ নদী অববাহিকায় জীবনধারণকে হুমকির সম্মুখীন করে। একসময় বেলোয়ারি নদীর বুকে নৌকায় চেপে মানুষ মাছ সংগ্রহ করত এবং সুন্দরবনে যেত কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে। এখন মৃতপ্রায় নদীরা বনের গভীরে যাতায়াত সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন ও মানুষ। বনের প্রাণীরা লোকালয়ে চলে যায় আবার লোকালয়ের পোষ মানা প্রাণীও বনের ভেতরে প্রবেশ করে হিংস্রতার শিকার হচ্ছে। এছাড়া জাহাজ, নৌযান নিয়মিত যাতায়াত করে সুন্দরবনসংলগ্ন অন্য নদী বেয়ে। বিষাক্ত রাসায়নিক পণ্যবাহী জাহাজডুবি প্রায় নদীগুলোকে বিষিয়ে তোলে। ফলে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বলা হয় নদীর নাব্যতা ফেরাতে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হলো ড্রেজিং। উন্নত দেশেও এ পদ্ধতিতেই নদীর নাব্যতা ধরে রাখা হয়। এখানেও ড্রেজিং পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলো দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের চেয়ে ভাটার স্থায়িত্ব এখন বেশি। ফলে একদিকে যেমন বনের জলাশয়ে লবণাক্ততা বাড়ছে, তেমনি পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদী। এছাড়া পলি জমে জায়গা ভরাট হওয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরির পাশাপাশি মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে, যা মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য খাবার পানির সংকট বাড়াচ্ছে। আবার লবণাক্ত পানি কৃষিজমিতে সেচ প্রক্রিয়াও ব্যাহত করছে। কৃষি উৎপাদন কমছে এবং কৃষকরা এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন। বলা বাহুল্য, উন্নত দেশে ড্রেজিং কার্যকরী ভূমিকা রাখলেও এখানে তেমন কোনো পরিবর্তন রাখতে ব্যর্থ। কারণ উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অসংখ্য দেশ, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্য দেশগুলো বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে এটি করে থাকে। একেক নদীর গঠন কাঠামো আলাদা। কেবল বালি উত্তোলন করে খননকাজ করলেই নদীর নাব্যতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। এজন্য চাই নদী বিশেষে বিশেষ ব্যবস্থা। নদী নিয়ে গবেষণা তাই জোরদার করা উচিত। প্রতিটি নদীর গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে এর ব্যবস্থাপনাও আলাদাভাবে করতে হবে। সারা দেশেই নদীর নাব্য সংকট বর্তমান। সুন্দরবন বিধৌত নদীসহ দেশের সব নদীর পানিপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিকূল জলবায়ুর পাশাপাশি মানুষের অসচেতন কর্মকাণ্ডও নদীর নাব্যতা হ্রাসে দায়ী। নগরায়ণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, মৎস্যসম্পদের অতি আহরণে সংকটাপন্ন দেশের নদীগুলো। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার ত্রুটি। জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেস অয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত করে এবং বনের জলজ প্রাণীদের জীবননাশ করে। কেননা এতে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসে। এছাড়া পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হলে সেখানে মানুষ দখলদারত্বের মাধ্যমে বসতিসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছে। এতে পানিপ্রবাহ বাধা পায়। তবে নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণের দায় অস্বীকার করার অবকাশ নেই। দেশের ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। সুতরাং নদীর নাব্য সংকট কাটাতে যে পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন, পানি নীতিতে ভারতের কার্যক্রম গুরুত্বসহকারে বিচার করতে হবে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তির পর বাংলাদেশে গঙ্গার পানির অংশ দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ২০ হাজার ঘনফুটের কম। অথচ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ প্রায় ৭০ হাজার কিউসেক পানি পেত। গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ নদীর প্রতি বাংলাদেশেরও অধিকার আছে। আন্তর্জাতিক নদীর বিষয়ে কোনো দেশ এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। জাতিসংঘ নদী কনভেনশনে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারে ন্যায়ানুগ ও সংগত আচরণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যেকোনো কাজের মাধ্যমে অন্যের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করা যাবে না। অভিন্ন নদী ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠনের মতো সুযোগ রয়েছে। সুতরাং দেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর নাব্য সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গড়ে তুলতে হবে। তবে যেকোনো সমস্যা মোকাবেলায় শুরুতেই দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার পথে হাঁটা উচিত। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধান করা না গেলে জাতিসংঘের নদী কনভেনশনের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পানি-সংক্রান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি করা যাবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মাধ্যমে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। গঙ্গা নদীর ওপর ভারতের এককভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সুরাহা করতে হবে। একই সঙ্গে নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নদীতে পলি জমবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পলি অপসারণে নিয়মতান্ত্রিক উপায় অনুসরণ করা জরুরি। দেখা যায় পলিগুলো নদীর কাছেকোলে কোথাও জমিয়ে রাখা হয়। জোয়ার-ভাটায় তা পুনরায় নদীগর্ভে নিপতিত হয়। ফলে নদী ভরাটের সমস্যা দেখা দেয়, যা নাব্য সংকটের অন্যতম কারণগুলোর একটি। খননকাজের সঙ্গে পলি কোন জমিতে অপসারণ করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করা জরুরি। স্বাদু ও লোনা পানির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ভূ-প্রকৃতি। এ বনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ জলাভূমি। প্রায় ৪৫০টি নদী-খাল বনের অলিগলি দিয়ে প্রবাহিত হয়। যদিও এর মধ্যে অনেক নদী এখন মৃতপ্রায়। সরকারি উপাত্ত বলছে, সুন্দরবনবিধৌত ৫৩ নদী বর্তমানে নাব্য সংকটে রয়েছে। নদীগুলো ভরাট ও দখলদারত্ব, অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ, বিরূপ জলবায়ু এবং মানুষের অসচেতন কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষীণকায় হয়ে আসছে। ফলে নদীগুলোয় পানিপ্রবাহ কমে লবণাক্ততা বাড়ছে, সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এবং অববাহিকায় বসবাসরত মানুষের জীবিকা উপার্জনে। এমনকি ব্যাহত হচ্ছে নদীপাড়ের কৃষি উৎপাদন। আশঙ্কা রয়েছে নদীর নাব্যতা ফেরানো না গেলে উদ্ভূত সমস্যা আরো প্রকট হবে। দেশের ৬০ শতাংশ আমিষ আমরা পাই পানিতে প্রাপ্ত মাছ থেকে, যা দেশের জিডিপিতে ৩.৬১ শতাংশ অবদান রাখে এবং এই পেশায় দেশের ১১ শতাংশ জনগণ নির্ভরশীল। গবাদি পশু-পাখিও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিজাত পণ্যের বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল, যার পুষ্টি জোগান দেয় নদী বা ভূগর্ভস্থ পানি। চর্বি বা স্নেহজাতীয় খাদ্য শরীরে শক্তি উৎপাদন করে এবং এই চর্বি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য শরীরের শক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে, যা শরীরকে নিম্ন তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করে। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে; খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও তৃপ্তিকে অনুভব করতে সাহায্য করে; এই স্নেহজাতীয় খাদ্য তৈরি হয় বা আসে মূলত গরু বা খাসির মাংস, মুরগি, ভেড়া, হাঁস, দুধ, পনির, নারিকেল, বাদাম, তাল ইত্যাদি থেকে। সুতরাং পরোক্ষ ভাবে উৎপাদনকারী সবকিছুই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে ভূগর্ভস্থ বা নদী বা বৃষ্টির পানির মাধ্যমে। বাংলাদেশের মতো দেশে স্বাভাবিকভাবেই এই পানির প্রধান জোগান দাতা সারাবছর মূলত বাংলাদেশের নদীগুলো। সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুন্দরবনের জলরাশিতে রয়েছে বিপুল মৎস্যসম্পদ। এখানে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া এবং প্রায় ৪২ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। এ বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। সুতরাং বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে এবং নির্ভরশীল জন গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নাব্য সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। আর এজন্য দরকার যথাযথ ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে প্রত্যেক অঞ্চলেই নৌপথে যোগাযোগ করার মতো নদী আছে। কিন্তু সড়ক পথের উন্নয়নের দিকে অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের নদ-নদীতে নাব্য বজায় রেখে নৌপথের যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে নৌপথ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। নৌপথ খননের মাধ্যমে সচল রাখতে পারলে সড়ক পথের বর্তমান উন্নয়নের সঙ্গে মিলেমিশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে প্রিয় স্বদেশে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত