ভূমিকম্প : সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে

মীর আব্দুল আলীম

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বড় ধরনের ভূমিকম্প যে দুয়ারে, তা বারবার বলছেন ভূতত্ত্ববিদরা। দেশে অব্যাহতভাবে ছোট-মাঝারি ভূমিকম্প হচ্ছে। সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল পাবনার আটঘরিয়ায়। এর আগে গত বছরের ২ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পে মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছে দেশ। দেশবাসী বড় ভূমিকম্পের আতঙ্কে আছে। বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে কী হবে, উদ্ধারের সংগতি- এসব ভাবনা অনেকের। ভূমিকম্প হলে উদ্ধারে বড় পরিকল্পনা কতটুকু আছে? এখনো আমাদের দেশে ভবন নির্মাণ হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। নিয়ম না মেনে যে যার মতো ভবন তৈরি করছে। ঢাকার মতো গিঞ্জি শহরে এতো বহুতল ভবন বোধকরি বিশ্বের আর কোথাও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে ভূমিকম্প কম হলেও রাষ্ট্রের ভাবনা অনেক। বসবাসের ভবনগুলোর অধিকাংশ ২ কিংবা তিন-চার তলার হয়ে থাকে। ভবনগুলো ভূমিকম্প নিরোধক করা হয়। আমাদের দেশ এতোটা ভূমিকম্পপ্রবণ যে, সারাবিশ্বের ভূতত্ত্ববিদরা দীর্ঘদিন ধরেই এখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। এই অবস্থায়, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর আমাদের সক্ষমতা কতটুকু তা আমরা টের পেয়েছি। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী হবে? তুরস্ক, নেপাল, চীন ও ভারতে যে মাত্রার ভূমিকম্প হয় সেই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে বা হেলে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাণ হারাবে হাজার হাজার মানুষ। সেক্ষেত্রে সারা দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, এর আগে ঢাকার এত কাছে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়নি। ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ৩.৯, আর ৫ মে দোহারে ৪.৩ মাত্রার এবং ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কুমিল্লায় ৪.২ থেকে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্প নিয়ে আগাম কিছুই বলা যায় না, তবে আশার কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শেষের ভূমিকম্পটির সৃষ্টি হয়েছে ছোট ফাটল রেখায়। সেই কারণেই ঢাকায় বড় কোনো বিপদের শঙ্কা নেই। ভূমিকম্পে এভাবে প্রায়ই কাঁপছে বাড়িঘর। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবং গভীরতা একেবারেই নিকটে চলে এসেছে। সবার ভয়, এই বুঝি ঘরটা ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। এই ভয় এখন সবাইকে পেয়ে বসেছে। ভূমিকম্পকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে। ভূমিকম্পে উঁচুতলার বিল্ডিংগুলো আগে ভেঙে পড়বে একথা ঠিক নয়। বরং ভূমিকম্পে হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের চেয়ে দুর্বল ছোট বিল্ডিংগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। ৬তলার নিচের বিল্ডিংগুলো বেশি অনিরাপদ। ভূমিকম্পে বিল্ডিং সাধারণত দুমড়েমুচড়ে পড়ে না; হেলে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এই সময় নিজেকে রক্ষা করতে হবে। কলামের পাশে শক্ত কোনোকিছু থাকতে হবে। বিশেষ করে খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিল হলে ভালো হয়। আগে থেকেই আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। ঘরে রাখতে হবে শাবল এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু দেশীয় যন্ত্র। ভূমিকম্প হলে অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিচে ছোটে। তারা জানে না, ভূমিকম্পে যত ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অস্থির লোকদের ক্ষেত্রে। ভূমিকম্প খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়। প্রলয় যা হওয়ার, তা হয় কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট সময়ের মধ্যে। এই সময়ে কি কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবে? রাস্তায় গিয়ে তো আরও বিপদে পড়তে হবে। বাড়িঘর হেলে গিয়ে ধসে পড়ে সবকিছু তো রাস্তার ওপরই পড়বে। বরং রাস্তায় থাকলে চাপা পড়ে, মাথা কিংবা শরীরের ওপরে কিছু পড়ে যে কেউ হতাহত হতে পারে। যারা একতলা কিংবা দোতলায় থাকে, পাশে খালি মাঠ থাকলে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারে। রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করে, যারা উঁচু বিল্ডিংয়ে থাকে, তাদের ভয়টা যেন একটু বেশি। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আমাদের দেশে ৬ তলার ওপরে নির্মিত বিল্ডিংগুলো সাধারণত নিয়ম মেনেই হয়। বড় বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রে অনেকেই ঝুঁকি নিতে চায় না। একটু দেখভাল করেই নির্মাণকাজ করে থাকে। আর এসব বিল্ডিং পাইলিং হয় অনেক নিচু থেকে এবং বেইজ ঢালাই দেওয়া হয় পুরো বিল্ডিংয়ের নিচ জুড়ে। তাই শুধু কলামে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের চেয়ে হাই রাইজ বিল্ডিং কিছুটা হলেও নিরাপদ বলা যায়। এই অবস্থায় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে। প্রথমত যা করতে হবে, পরিবারের সবার সঙ্গে বসে ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, মোটকথা পরিবারের ইমার্জেন্সি প্ল্যান কী, তা ঠিক করে সব সদস্যকে জানিয়ে রাখতে হবে। নিচের ১০টি বিষয় পরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে রাখা জরুরি। ১. কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়তে হবে। তারপর কোনো শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে যেতে হবে। ২. ভূমিকম্পের সময় কোন ফ্লোর নিরাপদ, কীভাবে দালান ভেঙে পড়ে, কাত হয়ে, নাকি এক তলার ওপরে অনেকে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। এটা ওই জায়গার মাটির গঠন, বিল্ডিং কীভাবে তৈরি, এর ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ভূমিকম্পের সময় চারভাবে ফ্লোর বা দালান ধসে পড়তে পারে। দালানের কোন তলা বেশি নিরাপদ এই ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মতামত হলো, ভূমিকম্পের সময় ওপরের দিকের তলাগুলোয় দুলুনি হবে বেশি, নিচের তলায় কম। কিন্তু দালান যদি উলম্ব বরাবর নিচের দিকে ধসে পড়ে, তাহলে নিচতলায় হতাহত হবে বেশি। ৩. ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি না করাই উত্তম।

৪. ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার করাও উচিত নয়। ৫. রাতে বিছানায় থাকার সময় ভূমিকম্প হলে গড়িয়ে ফ্লোরে নেমে পড়তে হবে। এটা বিল্ডিং ধসার পার্সপেক্টিভেই। ৬. ভূমিকম্পের সময় ভেতরের দিকে না থেকে বাইরের দিকে ওয়ালের কাছে আশ্রয় নেওয়া উচিত। ভূমিকম্পের সময় বাইরের ওয়ালের কাছে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ মূলত বিল্ডিং ধসে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বলা। ভূমিকম্পে যদি দালান ধসে পড়ে, তাহলে বাইরের দিকের ওয়ালের কাছে থাকলে ধংসস্তূপ থেকে তাড়াতাড়ি উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ৭. ভূমিকম্পের সময় গাড়ি বন্ধ করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে বসে বা শুয়ে পড়তে হবে। অবশ্য রেডক্রস বলছে গাড়ি বন্ধ করে গাড়ির ভেতরেই বসে থাকতে। গাড়ির বাইরে থাকলে আহত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ৮. সব বড় ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটি ছোট ভূমিকম্প হয়, যেটাকে ‘আফটার শক’ বলে। এটার জন্যও সতর্ক থাকতে হবে। ৯. বড় বড় এবং লম্বা ফার্নিচার, যেমন শেলফ ইত্যাদি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে, যেন কম্পনের সময় গায়ের ওপর পড়ে না যায়। ১০. প্রথম ভূমিকম্পের পর ইউটিলিটি লাইনগুলো (গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) দেখে নিতে হবে। কোথাও কোনো লিক বা ড্যামেজ দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুইটি, প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়া। দীর্ঘদিন যাবৎ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির কথা বলা হলেও উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থা এখনো খুবই শোচনীয়। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হলে বাড়িঘর ও হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।