পুলিশ রিমান্ডে শিক্ষক মুরাদ

সবার স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হোক

প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর দিবা শাখার গ্রেপ্তারকৃত সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে অভিযোগর ব্যাপারে পুলিশ হয়তো বিস্তারিত জানবে। তবে পুলিশ রিমান্ডে তিনি কি বলেছেন, কেনই বা তিনি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে সেটি প্রকাশ করলে আগামীতে অন্য ছাত্রী ও তাদের অভিভাবক সচেতন হবেন। সেই সঙ্গে এই ধরনের মনমানসিকতার শিক্ষকরাও যদি একটু নিজেকে সংশোধন করে নেন, তবে সেটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক ছাত্রী মুখ খুলছে। সবশেষ তথ্য অনুসারে তার বিরুদ্ধে ১৭ জন ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব ছাত্রীর বক্তব্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি ছাত্রীদের ওপরে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে। বিচার চেয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষক মমতাজ বেগমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ওই শিক্ষককে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত এবং তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে গত মঙ্গলবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিনজন ছাত্রীর অভিভাবক এবং আজিমপুর দিবা শাখার ‘যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি’র সদস্যরা শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিচার চেয়ে অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোট ৭৭ জন ছাত্রীর মধ্যে ৬০ জন ছাত্রী শিক্ষক মুরাদের পক্ষে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। আর ১৭ জন ছাত্রী নেতিবাচক মন্তব্য করেন। ছাত্রীদের কাছে লিখিত প্রশ্ন সরবরাহ করে এসব মন্তব্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের কথা ১৭ জন ছাত্রী উল্লেখ করলেও অভিযোগ রয়েছে ভয়ে অনেক ছাত্রী লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেননি। পিতৃতুল্য শিক্ষক তার সন্তানতুল্য ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করবে আর সেই খবর যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন কন্যাসন্তানদের অভিভাবকদের মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সেটা বলাবাহুল্য। গণমাধ্যমমে বিগত দিনে শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে হয়তো অভিযুক্ত শিক্ষকরা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। সাময়িক বরখাস্তের পর বিষয়টি কীভাবে সমাধানের পর্যায়ে পৌঁছায় তা সাধারণত পরবর্তীতে জানা যায় না। প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো শিক্ষক ছাত্রী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এ ধরনের খবর ছাপার অক্ষরে পড়তে কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখতে কোনো অভিভাবকই প্রস্তুত থাকেন না। শিক্ষকরা ক্লাসরুমে, নিজের অফিস রুমে কিংবা কোচিং সেন্টারে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করবেন এমন অধিকার তাদের কে দিল। তারা কোনো সাহসে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে সেটা বোধগম্য নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা যখন শিক্ষক নিয়োগ করেন, তখন ওই শিক্ষকের চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদানের শর্ত হিসেবে বিবাহিত হওয়ার শর্তজুড়ে দেয়া হয়। তবে তাতে কোনো সুফল মেলে কি না, সেটাও বলা মুশকিল। মুরাদ হোসেন বিবাহিত কি না তাও জানা যাচ্ছে না। ক্লাসরুম কিংবা কোচিং রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে হয়তো এমন ধরনের ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করার সুযোগ থাকত। এই ধরনের শিক্ষকের বিচার কীভাবে সম্পন্ন করা হবে তার একটা সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। ছাত্রী নির্যাতন ও নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকে কীভাবে শাস্তির আওতায় আনা যাবে, সেটা নিয়েও একটু ভাবতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নৈতিকতার শর্তজুড়ে দিতে হবে কি না, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডে অভিভাবকরা রীতিমতো চিন্তিত হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কোনো ছাত্রীর অভিভাবক তার সন্তানদের জন্য কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন সেটা সীমিত ও সৎ অভিভাবকরাই শুধু উপলব্ধি করতে পারেন। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত না করে যৌন হয়রানিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কারা দায়ী তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে। ছাত্রী যদি শিক্ষকের হাতে লাঞ্ছিত হয়, তাহলে সেই ছাত্রীর পরবর্তী জীবন কতটা দুর্বিষহ হয় কিংবা অভিভাবকরা কি ধরনের মনোবেদনার মধ্যে থাকেন, সেটা কন্যাসন্তানের পিতামাতা ছাড়া অন্য কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির খবর মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কয়েকদিন প্রশাসন ও গণমাধ্যম সক্রিয় হয়। কয়েকদিন পর নদীর ঢেউয়ের মতো তা কিনারায় মিশে যায়। অতীতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অভিযুক্ত শিক্ষক এই ধরনের আচরণ করা থেকে বিরত থাকতেন। বাংলাদেশ নানা সামাজিক সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী যৌন হয়রানিকে কঠিন সামাজিক সংকট হিসেবে গণ্য করে এর একটা বিহীত না করলে কন্যাসন্তানদের উচ্চ শিক্ষা ব্যাহত হবে এবং ‘শিক্ষক ভীতি’ আতঙ্কে লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাবে।