ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবনের প্রধান ডিগ্রি বিনয়!

রাজু আহমেদ
জীবনের প্রধান ডিগ্রি বিনয়!

শিক্ষাগত উচ্চতর ডিগ্রি আজকাল প্রায় সবার আছে; কিন্তু পেশাগত জীবনে প্রধান ডিগ্রি হচ্ছে আপনার বিনয়। মানুষ হওয়ার মানদ-ও বিনয়। অন্যের ব্যথা বুঝতে পারা, দরদ ধরা, সহানুভূতি দেখানো, সহমর্মি হওয়া এসব পারিবারিক শিক্ষার অংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনো কখনো আপনাকে অহংকারী করতে পারে, পদণ্ডপদবি আপনাকে দাম্ভিক বানাতে পারে! আদব-কায়দা কিংবা কাউকে সম্মান দেখানো- এটা পারিবারিক শিক্ষায় ব্যাপকভাবে না থাকলে শেখা ও ধারণ করা মুশকিল। শিক্ষিত হওয়া মানে মানুষ হওয়া? মানুষ হওয়ার জন্য নিজের চেষ্টা থাকতে হয়। ভালো-মন্দের, সত্য-মিথ্যার এবং উচিত-অনুচিতের পার্থক্য বোঝার পরে খারাপ বিষয়গুলো ত্যাগ করা এবং ভালো অনুষঙ্গগুলো আঁকড়ে ধরার যে দৃঢ়তা সেটাই শিক্ষা। পরিবার সেই শিক্ষার লালন ও চারণভূমি। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। বড়রাও অন্যের দ্বারা সংক্রমিত।

পরিবারের সদস্যরা যা করে, যা বলে শিশুরাও সেটাই লালন কতে শুরু। যে বাবা-মা মিথ্যা বলে, অহংকার করে, কথা ও আচরণে দাম্ভিকতা দেখায়, ঝগড়া করে কিংবা হাতাহাতি করে তাদের সন্তানরাও সেগুলোতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। অথচ বাবা-মা সৎ হলে, বিনয়ী হলে, দান করলে, পরকে সম্মান দিলে, আত্মীয়দের খোঁজ নিলে তাদের সন্তানরাও সেই পথেই হাঁটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গরুর রচনা, যোগ-বিয়োগ, গ্রামার যেভাবে শেখাতে পারে, সেভাবে হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের বিনয়ী হতে শেখাতে পারে না! শিক্ষক সত্য বলার তাৎপর্য বর্ণনা করতে পারেন, দেশপ্রেমের উপকারিতা বলতে পারেন, আগামীদিনের স্বপ্ন দেখাতে পারেন; কিন্তু সেসবের চর্চা এবং লালন ভূমি পরিবার। পরিবার বিপথে চললে সেই পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তান সুপথে ফিরবে তার সম্ভবনা সিকিভাগেরও কম! পদণ্ডপদবির ক্ষমতা, বিত্ত-বৈভবের গরম, ক্ষমতার দম্ভ যদি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে ভুলিয়ে দেয়, তবে পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।

ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বভাব, হিংসায় পরিপূর্ণ মনোভাব, আত্মণ্ডঅহমিকা কিংবা বড়াই মানুষ হওয়ার পথের বড় অন্তরায়। ক্ষণিকের ক্ষমতা, প্রবাহিত সম্পদের কিছু হাতে আসা, পালাবদলের যশ-খ্যাতি এসব অহংকারের চাদর হয়ে টিকে থাকে। আমিত্ব কিংবা ‘কী হনুরে’ মতাদর্শ অপরের ঘৃণার কারণ হয়। যে আচরণ, যে স্বভাব মানুষকে মানুষের থেকে দূরে ঠেলে দেয়, সেটা এই সমাজের কাঙ্ক্ষিত আচরণ নয়। পরিবার যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তবে সেই পরিবারে লালিত বীজ বটবৃক্ষ হতে পারে না। যেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য করার শিক্ষা দেয়া হয়, কুআচরণের দীক্ষা থাকে, সেখান থেকে আলোকিত মানুষে পরিণত হওয়া কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বিনয়ী মানুষ হওয়ার চেষ্টা বারিত রাখতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কী একেবারেই দায়িত্ব নেই? আছে। শিক্ষার্থীরা গঠনকালের একটা বড় অংশ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাটায়। সেখানে শিক্ষক আদর্শবান হলে, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলে, অপরকে সম্মান দেয়ার মানসিকতা দেখালে, নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে না আনলে, লোভের কলেবর বৃদ্ধি না করলে কিংবা ক্লাসরুমে ফাঁকি না দিলে কোমলপ্রাণ আলো হয়ে ওঠে। সামাজিকীকরণের সবচেয়ে বড় ধাপটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সূচিত ও সম্পন্ন হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে ঋদ্ধ হওয়ার সুযোগ মেলে। একজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিকাশে কখনো কখনো বাবা-মায়ের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্জন-বর্জনের বোধ তৈরি হয়। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, মানুষের মনে থাকার জন্য বিনয় ভূষণ হোক। কত মানুষের মধ্য থেকে বাছাই করে আপনাকে শ্রেষ্ঠ করা হয়েছে, অর্থ-সম্মান পেয়েছেন তা একবার চিন্তা করলেই তো বিনয়ে শির নত হয়ে আসা উচিত। কত মেধাবি ঝরে গেছে, কত বন্ধু সুযোগ পায়নি অথচ আপনি সাফল্য পেয়েছেন। শুধু চেষ্টাতেই কি স্বপ্ন বাস্তব হয়? নসীবেও থাকা লাগে। সবকিছুর সম্মিলনে যে আত্মণ্ডপ্রশান্তি সেখানে যদি বিনয় না থাকে, মমত্ববোধ-সহানুভূতবির অভাব থাকে, চরিত্রের কালিমা থাকে, অধিকার হরণের ইতিহাস থাকে কিংবা দায়িত্বের অবহেলা থাকে তবে দাতা ক্রুদ্ধ হতে পারেন! শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে বিনীত হওয়া জরুরি। এই সমাজে শিক্ষায় যোগ্য-এমন লোকের অভাব নেই। অভাব হচ্ছে বিনীত মানুষের। যিনি বিনীত হয়েছেন তিনিই বড় হয়েছেন। আপনি বিনীত হবেন কি-না, সেটা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে। স্রষ্টা আপনাকে বিনীত হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা করেন! বিনয় আপনার আর পাঁচটা দোষ আড়াল রাখতে পারে। আপনার অযোগ্যতা ক্ষমা করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত