ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সন্তানকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে

গোলাম সরোয়ার
সন্তানকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে

মাদকের ছোবল সন্তানকে ইনফিনিটি মহাশূন্যের দিকে নিয়ে যায়। একেবার এই স্বপ্নের এ স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়লে সেই সন্তানকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে ফেলে মাদক, তখন মহাশূন্যের এই স্বপ্নপুরী থেকে ফিরে আসতে পারছে না সন্তানরা। আগামীর সম্ভবনা এই সন্তানদের রক্ষা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু কে নেবে উদ্যোগ এবং কীভাবে?

হাত বাড়ালেই মেলে মাদক। চারপাশে মাদকের হাট। কখনো কুমোড়ের ভেতর, পেটের ভেতর, দিয়েশলাইয়ের বক্সে, গাড়ির জ্বালানি তেলের ট্যাংক আবার মোটরবাইকের সিটের ভেতরসহ নানাভাবে মাদক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

আমাদের সন্তানদের মাদকের এই মরণ ছোবল থেকে রক্ষা করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে বাবা-মা পরিবার শিক্ষক ও প্রশাসনকে। সচেতন হতে হবে সবাইকে। প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার চালান ঢুকে পড়ছে এই নগরীর আদ্যঃপ্রান্তে, কিছু সন্ধান পায় প্রশাসন বাকিগুলো অধরাই থেকে যায়। ভয়াবহ এই মাদক আমাদের সন্তানদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী স্কুলজীবন থেকেই ঝুঁকে পড়ে মাদকের সঙ্গে। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে ওাার আগেই তারা মাদকের নেয়ায় বুঁদ হয়ে যায়। বাবা-মা কিংবা পরিবার যখন জানতে পারে, তখন ওই সন্তানকে মাদক থেকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। মাদকের ছোবল একদিকে যেমন মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, তেমনি পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মাদকের ছোবলে ধ্বংসের পথে গেছে এমন অনেক প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। বরিশালের নামী একটি বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর জীবনের ঘটনা। ওই শিক্ষার্থী যখন অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়ন করত। ওই সময়ে তাকে মাদক নেশা হাতছানি দিতে থাকে। ওই বিদ্যালয়ের কয়েক মাদকবন্ধু শিক্ষার্থীর তালে পড়ে যায় ওই শিক্ষার্থী।

প্রতিদিন ওই শিক্ষার্থীকের তার বাবা স্কুলে পৌঁছে দিত এবং ছুটির পর বাড়িতে নিয়ে আসত। হঠাৎ একদিন শিক্ষার্থী তার বাবাকে বলে, তুমি স্কুলে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে হাঁটবা না। আমি ১০ গজ আগে হাঁটব, আর তুমি ১০ গজ পেছনে। বাবা বিষয়টি বুঝতে পারে না। সে তার কন্যার কথায় রাজি হয়ে যায়। কন্যার কথা অনুযায়ী স্কুলে দিয়ে আসে এবং স্কুল থেকে নিয়ে আসে। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কিছু দিন। কিন্তু বাবা-মেয়ের সঙ্গে থাকায় মাদকের সঙ্গে যুক্ত বন্ধু শিক্ষার্থীকে মাদকের সঙ্গে যুক্ত করতে পারছিল না, তারা ওই শিক্ষার্থীকে বলল, তোর বাবা তোর সঙ্গে আসে কেন? তার আসা বন্ধ করতে হবে।

মাদকবন্ধু শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা কাজে লাগায় ওই শিক্ষার্থী। সে তার বাবাকে বলে, বাবা তুমি আমার সঙ্গে স্কুলে গেলে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেব। বাবা তখনও বুঝতে পারে না। তিনি মনে করেন নবম শ্রেণিতে পড়ুয়াকন্যার সঙ্গে যাওয়ার বিশেষ দরকার নেই। তারপরও বাবার মন মানে না। বাবা স্কুল দারোয়ানকে অনুরোধ করেন স্কুল ছুটি হলে তিনি যেন তাকে একটু জানায়। স্কুল দারোয়ান ছুটির সঙ্গে সঙ্গে ওই বাবাকে ফোন করে জানাত।

কিন্তু মাদক বন্ধু শিক্ষার্থীরা দেখল, ছুটির সঙ্গে সঙ্গে বাবা জানতে পারছে। এবার তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা স্কুল দারোয়ানকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে। এবার আর বাবা জানতে পারছে না, কখন মেয়ের ছুটি। এই না জানার ফাঁকে শিক্ষার্থীরা মিলে মাদকে বুঁদ হতে থাকে। এরমধ্যেই দশম শ্রেণিতে উঠে যায় কন্যা। এবার পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়তে থাকে। তারপরও বিশেষ মেধাবী হওয়ায় মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েই উত্তীর্ণ হয়।

কলেজে ওঠার পর মাদকের নেশা কঠিনভাবে পেয়ে বসে ওই শিক্ষার্থীকে। এবার মাদকবন্ধু নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হয় ছেলে মাদকবন্ধুরা। সন্ধ্যার আগে ওই শিক্ষার্থীর বাড়ি ফেরা অনিয়মিত হতে থাকে। কখনো ৯টা, ১০টা, ১১টা, আবার কখনো রাত ২টা। কখনো পুলিশের হাতে ধাওয়া খাওয়া এবং দুই-একবার আটকের ঘটনাও ঘটে। কলেজপড়ুয়া হওয়া এবং মিথ্যা বলে কয়ে পাড় পেয়েও যায়। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় বাবা-মা। কিন্তু তাদের আর কিছু করার থাকে না। নানা অজুহাতে অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকে নারী ওই শিক্ষার্থী। এভাবে মাদকের জোগান দিতে দিতে ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার।

এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হয় নগরের এক সংগঠনকর্মীর সঙ্গে। গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সংগঠক ও সংগঠনের সঙ্গে। সংগঠনকে ভালোবেসে ফেলে ওই মাদকাসক্ত শিক্ষার্থী। এক সময় মাদকের সাগরে অবগারণের নির্মম ঘটনা বর্ণনা করে সে। পরে সেখান থেকে কাউন্সিলিং করে তাকে ফেরানো গেছে। বর্তমানে ভালো আছে ওই বন্ধ। গল্পটা কিন্তু এত সংক্ষেপ নয়। এটা মাদকের হাটে মিলে যাওয়া বিশাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি মাত্র ঘটনা। যা ভুক্তভোগীদের মাধ্যমেই বুঝা যায়। আর ওসব শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা শুধু নিঃশ্বাস ফেলেছে চোখের পানিতে। তার প্রিয় সন্তানকে মাদক থেকে ফেরাতে পারছেন না। তিলে তিলে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে প্রিয় সন্তান এবং গোটা পরিবার।

আমরা চাই, এরকম যেন কোনো শিশু শিক্ষার্থীকে মাদক স্পর্শ করতে না পারে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন মাদক প্রবেশ করতে না পারে। বাবা-মা যেন সন্তানের বন্ধু হতে পারে। আমাদের সন্তানরা যেন মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা পাবে।

মাদকের ছোবল থেকে প্রিয় সন্তান এবং স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো কঠোর অবস্থান নিতে হবে। শুধু মাদক বিক্রেতাকে আটক নয়, মাদকের মদদ দাতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদকের ব্যাপারে শূন্য সহসাশীল (জিরো টলারেন্স) নীতি অনুসরণ করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের সবাইকে সচেতনতা সোচ্চার করতে হবে মাদকের বিরুদ্ধে।

কবি ও গল্পকার, র‌্যাব প্রধান কার্যালয়, উত্তরা, ঢাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত