ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্য খাতকে পুনরুজ্জীবিত করে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি

ডা. সমীর কুমার সাহা
স্বাস্থ্য খাতকে পুনরুজ্জীবিত করে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ যেখানে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা প্রায় চ্যালেঞ্জিং কাজ। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলায় বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের প্রতি আস্থা না থাকায় রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে যান। আমাদের দেশ তখন উন্নত হবে যখন স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হবে এবং লোকজন ভালো চিকিৎসাসেবা পাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার স্বাস্থ্য খাতে ভালো সাফল্য অর্জন করেছে। টিকাদান কার্যক্রম গতি পেয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, মা ও শিশুর মৃত্যুহার কমেছে। তবে এই মুহূর্তে মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয় অনেকাংশে বেড়েছে। সরকারি একটি হিসাব অনুসারে, মানুষ এখন স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণের জন্য তাদের পকেট থেকে মোট খরচের ৬৭ শতাংশ ব্যয় করছে, যেখানে এর বৈশ্বিক মান হলো ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা ছিল অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য খাত এই জনবহুল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে সাফল্য অর্জন করেছে। সাফল্যের মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। কমিউনিটি ক্লিনিক বিনামূল্যে ২৭ ধরনের ওষুধ বিতরণের পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সুনাম অর্জন করেছে। বর্তমানে সারা দেশে ১৩৮৮১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে যেখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন রোগী প্রতি ক্লিনিক থেকে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ওষুধের তীব্র সংকটের মুখে পড়ে। এই মুহূর্তে দেশটি ওষুধ খাতে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে এই মুহূর্তে ১২৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে ওষুধ। আরেকটি সফলতা হলো এক্সপেন্ডেড প্রোগ্রাম অব ইমিউনাইজেশন (ইপিআই)। এটি একটি প্রকল্প যার লক্ষ্য শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া। অনেক শিশু (২২ শতাংশ) প্রতি বছর তাদের জন্মের পর পোলিও, টিবি, হাম, রুবেলা, টিটেনাস এবং কাশিতে মারা যেত। ১৯৭৯ সালে পাইলট প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর শিশুমৃত্যুর হার ২ শতাংশের উপরে নেমে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে পোলিও মুক্ত ঘোষণা করে। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি তার সাফল্যের জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মোট উর্বরতার হার (টিএফআর) ছিল ১৯৭১ সালে ৬.৯, অর্থাৎ একজন মা গড়ে প্রায় সাতটি শিশুর জন্ম দিতেন। ২০২১ সালে এই টিএফআর ১.৯৭৯-এ নেমে এসেছে।

এমডিজি বাস্তবায়নে সাফল্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ এখন এসডিজি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত, বাংলাদেশ এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। মায়ের মৃত্যুহার হ্রাস : প্রায় ৫০ বছর আগে, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এক লাখ প্রসবের ক্ষেত্রে প্রায় ৬০০ জন মা তাদের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতেন। স্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে এখন তা ১৬৫-তে নেমে এসেছে। দেশে মাথাপিছু আয়ু নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে, মাথাপিছু গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৬ বছর, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। চিকিৎসা শিক্ষার সম্প্রসারণে উন্নতি হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশে সাতটি মেডিকেল কলেজ এবং একটি মাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে দেশে বেসরকারি ও সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ১১৪টি। এছাড়া মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে পাঁচটি। বাংলাদেশ টেলিমেডিসিনের যুগে প্রবেশ করেছে। এই মুহূর্তে ১০০টি হাসপাতালে এই ধরনের পরিষেবা পাওয়া যায় এবং বেসরকারি উদ্যোগেও এই ধরনের পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। অনেক সাফল্য সত্ত্বেও, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। অবকাঠামো ও জনবলের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটি বড় সমস্যা। ধরুন, একটি উপজেলায় ১৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল খোলা হয়েছে, কিন্তু সেখানে জনবল মাত্র ৫০ শয্যার। অর্থাৎ অবকাঠামো বাড়ানো হলেও এর জন্য জনবল বাড়ানো হয়নি। এছাড়াও এমন উদাহরণ রয়েছে যে, একটি হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে কিন্তু কোনো নার্স এবং সহায়তাকারী কর্মীবাহিনী নেই। এটি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের বোঝা কীভাবে কমানো যায় তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে টাকা খরচ করতে গিয়ে অনেকেই গরিব হয়ে পড়ছেন। এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের নগর ও শহরে স্বাস্থ্য অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে কম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি রেফারেল হাসপাতাল যেখানে শুধুমাত্র গুরুতর রোগীদের ভর্তি করার কথা। কিন্তু দেখা যায়, ওই হাসপাতালের আউটডোর বিভাগে বিপুল সংখ্যক রোগীর ভিড়। এ ধরনের রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাওয়ার কথা। এই ধরনের রোগীরা নগর দরিদ্র এবং ঢাকায় নগর দরিদ্রদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র কম রয়েছে। তাই নগর স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ভাবা জরুরি। আমাদের রেফারেল সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করছে না। এর অর্থ হলো প্রথমে একজন রোগীকে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে যেখানে একজন চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন যে এখানে রোগীর চিকিৎসা সম্ভব নাকি অন্য জায়গায় রেফার করা হবে। কিন্তু এটি এখন কাজ করছে না, কারণ আগের দিনের মতো এই আধুনিক যুগে শুধুমাত্র একটি ট্যাবলেট দিয়ে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা আর সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মান উন্নয়ন প্রয়োজন। তাহলে রেফারেল হাসপাতালে রোগী আসবে না এবং রেফারেল সিস্টেম কাজ শুরু করবে না। চিকিৎসা শিক্ষার সাথে যারা জড়িত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য একটি সমস্যা তৈরি করেছে। যারা চিকিৎসা শিক্ষার সাথে জড়িত তারা প্রধানত ধনী বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, অন্যদিকে রোগীদের অধিকাংশই দরিদ্র। গরিব রোগীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধনী চিকিৎসকদের ধারণা খুবই কম। তাই ধনী ডাক্তাররা তাদের গরিব রোগীদের অনেক সমস্যা বুঝতে পারেন না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত