ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নিমতলী থেকে বেইলি রোড : আর কত জল গড়াবে?

অলোক আচার্য
নিমতলী থেকে বেইলি রোড : আর কত জল গড়াবে?

অগ্নিকাণ্ডের মৌসুমের শুরুতেই একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন আবারো আমাদের স্মৃতিতে জেগে উঠল। এমনিতেই আমাদের মগজে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির অনেক স্মৃতি জমা রয়েছে। তা হোক নিমতলী অথবা চকবাজার। এই তো গত বছরই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়েছে। আবার নতুন একটি অপমৃত্যুর অধ্যায় আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে গেল। রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে আটতলা ওই ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমাদের দেশে যে দুর্ঘটনাগুলো সচরাচর দেখতে পাই এবং যার কারণে প্রাণহানি থেকে শুরু করে বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেটি হলো অগ্নিকাণ্ড। রাজধানীর ব-তল ভবনগুলোর অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ এবং কর্তৃপক্ষ বার বার সতর্ক করলেও কোনো এক রহস্যজনক কারণে এসব ভবন সে অবস্থাতেই থেকে যায়। যখন এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রাণহানি ঘটে, তখন এসব বিষয় সামনে আসে। বেইলি রোডের এই ভবনটিও সেরকমই একটি ভবন। গ্রিন কোজি কটেজ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ভবন কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তাসহ নানা কারণে তিনবার নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।

এত বড় একটি ভবনে মাত্র একটি সিঁড়ি, লিফট রয়েছে দুটি, এছাড়া কোনো ফ্লোরেই ছিল না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। এ ছাড়াও যেভাবে গ্যাস সিলিণ্ডার সিঁড়িতে রাখা হয়েছিল তা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই যে এত এত প্রাণহানি ঘটছে তাতেও কি রাজধানীর ব-তল ভবন মালিকরা সচেতন হচ্ছেন? অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে একটি ব-তল ভবনে অবশ্যই থাকতে হবে ফায়ার এক্সিট। আগুন লাগলে বা জরুরি সময়ে যেপাশ দিয়ে মানুষজন নিরাপদে বের হয়ে আসতে পারবে। কিন্তু সেরকম কোনো রাস্তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাখা হচ্ছে না।

মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড। ফলে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা। ফায়ার এক্সিট না থাকায় মানুষজনকে জানালা দিয়ে বা দেওয়াল বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে নামতে দেখা যায়। কারণ তাদের জীবন বাঁচাতে হবে। এভাবে নামতে গিয়েও কারও কারও মৃত্যু হয়েছে। আর এভাবে নামাও যায় না।

সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও রাজধানী ঢাকায় ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। সেসব ঘটনায় পুড়ে ছাই হচ্ছে মানুষের সম্পদ। মানুষও পুড়ছে। তবে মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে বেশি।

শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পথে বসছে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আরো কয়েকটি মুখনির্ভর করে। সহায় সম্বল হারিয়ে পরিবারগুলোর শেষ পরিণতির খবর আর শেষ পর্যন্ত কেউ রাখে না। কারণ তার আগেই আরও একটি নতুন ঘটনা ঘটে। তখন সকলের দৃষ্টি যায় সেই ঘটনার দিকে। তবে আগুন লাগার ঘটনা এখন একটি কমন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতীতে দেশে বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির কারণ ছিল কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ। এছাড়াও শর্ট সার্কিট থেকে, বিভিন্ন অসতর্কতায় এমনকি সিগারেটের ফেলে দেওয়া টুকরো থেকেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি করুণ, মর্মান্তিক। এখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রয়েছে সতর্ক থাকার। বাস্তবে আমরা ততটা সতর্ক নই। সতর্ক থাকলে ছোট ছোট এই কারণগুলো এড়াতে সক্ষম হতাম। দেশের অনেক ব-তল ভবনে যথেষ্ট অগ্নি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকে না। এর কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসের করা ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। যখন ঘটনা ঘটে যায় তারপর বলি এবার থেকে হবে। আসলে হচ্ছে হবে করে সময় কেটে যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে এক যুগে প্রায় ৩৩৭ জন মানুষের প্রাণ গেছে কেমিক্যালের আগুনে। প্রতিটি ঘটনাই আগের দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়। আর কত প্রাণ গেলে আমরা সতর্ক হবো? নিমতলীর পর আগুন লাগে চকবাজার। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে গত বছর আগুনে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার সম্পদ পুড়েছে। প্রতিদিন হড়ে ৭৭টি করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর সাড়ে ২৭ হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮১৩টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এছাড়াও গ্যাস ও লাকড়ির আগুন থেকে বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আর সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে।

এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস অ্যা- সিভিল ডিফেন্সের বাৎসরিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষতি হয় ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং নিহত হয়েছেন ৩৮ জন। এছাড়াও ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৩০ জন সাধারণ মানুষ, তার পরের বছর ১৮৪ জন সাধারণ মানুষ ও ১ জন দমকলকর্মী, ২০২০ সালে নিহত হন ১৫৪ জন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে ২০২১ সালে। ওই বছর নিহত হন ২১৯ জন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে নিহত হয়েছেন ৭৭২ জন সাধারণ মানুষ এবং ১৪ জন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মী। রাসায়নিক পদার্থ থেকে ঘটনা অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই যে মানুষের প্রাণহানি, আহত এবং সম্পদহানি ঘটছে, সেসব প্রতিটি ঘটনার পেছনেই খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসছে ভুল। খুঁজে বের করা হয় অবহেলা। আমরা কি সেই ভুলগুলো শুধরে নেই? অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই। সেই নিয়ম মেনে সেসব থাকলে এক কথা আর তা না মানলে অন্যকথা। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই বহু ধরনের দুঘটনায় মানুষের প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে এই দুঘর্টনায় প্রাণহানিসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে অগণিত মানুষের স্বপ্ন। প্রাণহানি যেমন ক্ষতিকর, তেমনি একজনের সম্পদ পুড়ে যখন তার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন ছাই হয়ে যায়, তার খোঁজ কে রাখে।

আগুনে পোড়া স্বপ্নের মৃত্যু আর দেখতে চাই না। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই ঘটনার কারণ বের হয়ে আসার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার সুপারিশও করা হয়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। কিন্তু তাতে কি হচ্ছে? সেই আবার কোথাও না কোথাও আগুন লাগছে। কোনো বহুতল ভবনে, না হয় বস্তিতে- না হয় কোনো মার্কেটে ইত্যাদি। এভাবেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। প্রথম কিছুদিন সেসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। তারপর একসময় সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। এভাবে আর কতদিন চলবে? একটু সচেতন হলেই অগ্নিদুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। সাধারণ যে কারণগুলোতে সারাদেশে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাহলেই আগুন লাগার ঘটনা কমে আসবে এবং সেই সঙ্গে প্রাণহানি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমবে। তাছাড়া আরো একটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। আগুন লাগার পর যাতে দমকলকর্মীরা আগুন নেভাতে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ থাকতে হবে। সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জলাধার নির্মাণ করে, সেখানে জলের সরবরাহ রাখতে হবে, যাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় সেখান থেকে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ পেতে পারে। ফায়ার সার্ভিসকে অত্যাধুনিক সরঞ্জামে আরো আধুনিক করে গড়তে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত