ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রেম ও আমাদের স্বাধীনতা

রায়হান আহমেদ তপাদার
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রেম ও আমাদের স্বাধীনতা

শতবর্ষ আগে পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নেয়া ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহত্তম জীবনবোধ সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস রচনা করেছে হাজার বছরের শৃঙ্খল মোচনের এক অমর মহাকাব্য। তিনি প্রজ্বলিত এক নক্ষত্র, অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। বাঙালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন- তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, অহঙ্কারের সাতকাহন, আত্ম মর্যাদার প্রতীক-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু বাঙালির চেতনার রাজ্যে মুকুটহীন রাজা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জ্বলজ্বলমান যে নামটি, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৩ বছরের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে তার ডাকেই ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল দুর্গ। হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি ছিলেন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আর শরণার্থীদের রিফিউজি ক্যাম্পের মানুষগুলোর হৃদয় মাঝে ভাস্কর হয়ে। তার নামেই উজ্জীবিত হয়ে জীবনবাজি রেখে এক মুহূর্তের জন্যও কুণ্ঠিত হয়নি বাঙালি। বঙ্গবন্ধুকে যত বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়, তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক সাম্যবাদী বঙ্গবন্ধু অন্যতম। একজন মানুষ-কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী যাই হোন না কেন, তিনি যদি বর্ণবাদী কিংবা সাম্প্রদায়িক হন, তাহলে কোনো ক্রমেই তিনি পরিপূর্ণ একজন মানুষ কিংবা প্রকৃত যৌক্তিক কোনো মানুষ হতে পারেন না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে অর্থেও পরিপূর্ণ, যৌক্তিক অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অসাম্প্রদায়িক মহামানব। যত বড় বড় মহান মানুষ ও রাষ্ট্রনায়কের নাম পৃথিবীর ইতিহাসে রয়েছে যেমন- রুজভেল্ট, উইনস্টন চার্চিল, মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, বন্দরনায়েক তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি বড় তফাৎ রয়েছে। সেটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র (বাংলাদেশ) সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব চাননি।

তিনি মনেপ্রাণে, কাজেকর্মে ঘৃণা করতেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে রাজনীতি, সমাজনীতি ও সব ধরনের কুসংস্কারকে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি ইত্যাদি জাত-পাত বিদ্বেষের ঊর্ধ্বের মানস কবি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, ১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রায়িক দাঙ্গায় বহু মানুষ নিহত-আহত যখন হয়েছিল, যত্রতত্র মৃতদেহ আর পোড়া বাড়িঘর দেখে তার মনে হয়েছিল মানুষ আর মানবতা পশুতে পরিণত হয়েছে। তিনি সে সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চল থেকে অসহায় হিন্দু-মুসলমানদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। ১৯৬৪ সালে পাকি শাসকদের মদদে পূর্ব বাংলার তৎকালীন ঢাকায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তখনকার তেজগাঁও শিল্প এলাকার পাশে রেললাইনে ট্রেন থামিয়ে সংখ্যালঘু যাত্রীদের হত্যা করা হয়েছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢাকা শহরের সংখ্যালঘু কয়েকটি পরিবারকে নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর আমাদের বঙ্গমাতা বেগম মুজিব পরম যত্নে আদরে তাদের খাবার, শোবার ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি যে বিরাট এক অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন তার বড় প্রমাণ আওয়ামী মুসলিম লীগ বাদ দিয়ে তার দলের নাম করলেন আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাইকে ভাই ভাই বলে উল্লেখ করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণও বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার দলিল। দূর দৃষ্টিসম্পন্ন নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জাতি-উপজাতি, চাকমা, মারমা নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর চেতনা-আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানবতার মহামন্ত্রে লালিত হয়ে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক পশ্চিম পাকিস্তানি ধর্মান্ধ গোঁড়া বিবেকহীন নরপিশাচ কুলাঙ্গারদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র নিরীহ পূর্ববাংলার সাধারণ কৃষক শ্রমিক, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সাধারণ মানুষ আত্মরক্ষার্থে মুক্তির প্রত্যাশায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে জীবন-প্রাণ উৎসর্গ করে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষকে আদেশ দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধও করেছিলেন এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সুখে বাস করবে, পাশাপাশি বাস করবে। ভাই ভাই হয়ে বাস করবে। কোনো ধরনের সাম্প্রায়িকতা বাংলার মাটিতে যেনো না হয়- তাহলে আমি তা সহ্য করব না। সারাজীবন ভরে আমি সংগ্রাম করেছি এদেশের সবার জন্য। মুসলমান ভাইয়েরা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সব মানুষের খোদা, কোনো সম্প্রদায়ের খোদা তিনি নন, তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, সাম্প্রদায়িকতার বীজ যেনো বাংলার মাটিতে কেউ বপন না করে, তাহলে ৩০ লাখ যে শহীদ হয়েছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার পূর্ব বাংলার মানুষকে হিন্দু কিংবা বাঙালি বলে সহ্য করতেন না। ইতিহাস তার সাক্ষী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন পরবর্তী আচরণ, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতের ইতিহাস ও ৩০ লাখ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের হত্যা ও দুই লাখ নারী মুক্তিযোদ্ধার ওপর নির্যাতনের ইতিহাস। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ও তাদের দোসরদের লম্বা কলকে জিহ্বা যেনো বিষক্ষতের জন্ম দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার বাঙালির জন্য ছিল মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। সত্য কখনো চাপিয়ে, দমিয়ে ঠেকানো যায় না, প্রকাশিত হবেই, প্রতিষ্ঠিত হবেই। বিদেশি সাংবাদিক সিরিল ডাল যথার্থই বলেছেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বৈজ্ঞানিক যৌক্তিক চেতনা-মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা-এর প্রতিটি বিষয়েই অসাম্প্রদায়িক শব্দটি অন্তর্নিহিতভাবেই রয়েছে। এমনকি আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ৮(১) এ রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ঘোষিত হয়েছে যার প্রতিটিতেই বঙ্গবন্ধুর সমতা, বৈষম্যহীনতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকাশিত-প্রমাণিত হয়েছে। দেশ-জাতির কল্যাণ, মানবকল্যাণ ও মানবসভ্যতার ইতিবাচক পরিবর্তন কোনোক্রমেই এই চারটি মূলনীতির বিকল্প হতে পারে না।

আবার বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২-তে বলা হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রায়িকতা; খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে মর্যাদা দান; গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার; ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। অনুচ্ছেদ ২৮ (১) উল্লেখ না করলেই নয়, যাতে বলা হয়েছে- শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। আবার আমরা যদি অনুচ্ছেদ ২৮(৩)-এর দিকে তাকাই দেখতে পাই, সমতাণ্ডঅসাম্প্রদায়িকতার মহান নিদর্শন। অনুচ্ছেদ ২৮(৩)-এ উল্লিখিত হয়েছে- শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা ব্যধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না। বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি চিরন্তন চিরঞ্জীব; বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে অবিনাশী চেতনার নাম শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহানায়ক, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির মহান পথপ্রদর্শক, আবহমান বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ। তিনি বাঙালির অসীম সাহসীকতার প্রতীক-সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। বাঙালি ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালজয়ী নাম। বিশ্ববাঙালির গর্ব মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাঙালি মানসে জাতীয়তা বোধ সৃষ্টির নির্মাতা। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সীমাহীন ত্যাগ-তিতীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির অবিভাজ্য সম্পর্কের কোনো পরিসমাপ্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখাবে। বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এ মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত