ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ধোঁয়ার বিষেই জীবন শেষ

প্রদীপ সাহা
ধোঁয়ার বিষেই জীবন শেষ

সম্প্রতি (২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামের সাততলা ভবনে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পুরুষ, নারী এবং শিশু। ১১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন; জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। জানা যায়, ভবনের নিচতলায় দুটি মুঠোফোন ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান, একটি ফলের রস বিক্রির দোকান ও একটি চা-কফির দোকান ছিল।

দ্বিতীয় তলায় ছিল ‘কাচ্চি ভাই’ নামের একটি রেস্তোরাঁ, তৃতীয় তলায় ‘ইলিয়ন’ নামে একটি পোশাকের দোকান, চতুর্থ তলায় ‘খানাস ও ফুকো’ নামের দুটি রেস্তোরাঁ, পঞ্চম তলায় ‘পিৎজা ইন’ নামের একটি রেস্তোরাঁ, ষষ্ঠ তলায় ‘জেসটি ও স্ট্রিট ওভেন’ নামের দুটি রেস্তোরাঁ, সপ্তম তলায় ‘হাক্কাঢাকা’ নামের একটি রেস্তোরাঁ এবং ছাদের একাংশে ছিল ‘অ্যামব্রোসিয়া’ নামের একটি রেস্তোরাঁ। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না। অথচ বছরের পর বছর এ ভবনটিতে এতগুলো রেস্তোরাঁ চলছিল অনায়াসেই। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বিশেষ করে ২৯ ফেব্রুয়ারি হওয়ায় সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। কেউ গিয়েছিলেন তাদের প্রিয় শিশুসন্তানদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন স্বজনদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। আবার অনেকেরই জীবন চলত ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। নিমিষেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল পুরো ভবন। মৃত্যুর মিছিল আর বাঁচার তাগিদে হাহাকার করে ওঠে পুরো এলাকা। অবশেষে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কত মৃত্যু, কত কান্নার যে সাক্ষী হয়ে আছে ভবনটি, তার উত্তর কে দেবে? ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, আগুনের সূত্রপাত নিচ থেকে হলেও কোনো দোকান থেকে কীভাবে আগুন লেগেছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। ভবনটির প্রতি তলাতেই পাওয়া গেছে ৬ থেকে ১০টি করে রান্নার কাজে ব্যবহার করা এলপিজি গ্যাসের সিলিণ্ডার। সিঁড়ি এবং অন্যান্য জায়গাতেও ছিল এসব গ্যাসের সিলিণ্ডার। গ্যাস সিলিণ্ডারে আগুন লাগার কারণে পুরো সিঁড়িটি ‘অগ্নি চুল্লি’-এর মতো হয়ে যায়। ফলে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নিচে নামতে পারেনি। সিঁড়ি সরু হওয়ায় একত্রে তিনজনের বেশি যাতায়াতও সম্ভব হয়নি। সরু সিঁড়ি আর লিফট বাদে ভবনটিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের কোনো উপায় ছিল না। নিচতলায় থাকা গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরণ হওয়ার কারণেই আগুনের ভয়াবহতা বেশি হয়েছে। এত বেশি মৃত্যু আমাদের দেখতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঘটনার দিন রাত পৌনে ১০টার দিকে কাচ্চি ভবনের চারদিকে হঠাৎ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেকে চিৎকার করে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পুরো ভবনটিতে। পথচারী আর আশপাশের দোকান ও ভবন থেকে মানুষ ভিড় করতে শুরু করে পুড়ে যাওয়া ভবনটি ঘিরে। নিচ থেকে আগুন ওপর দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকা মানুষের বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নিচ থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন আর ধোঁয়া থেকে বাঁচতে সবাই ভিড় করেন ছাদে। ভবনটিতে আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ভেতরে আটকে পড়া মানুষগুলো ধোঁয়ার কারণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে অসচেতন হয়ে যায় এবং পরে মারা যায়। মারা যাওয়া বেশিরভাগ মানুষের শরীরে কোনো পোড়ার দাগ ছিল না। তবে এত মৃত্যু কেন হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক প্রবীর চন্দ্র দাস জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে ‘কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং’। ‘কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং’ হলো কোথাও আগুন লাগার পর অক্সিজেনের অভাব তৈরি হলে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। এর কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে, অক্সিজেনের অভাবেও মৃত্যু হতে পারে। তারা নিশ্চিত করেছেন যে, এ অগ্নিকাণ্ডে বিষাক্ত ধোঁয়ায়ই বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত ২০১০ সালের ৩ জুন ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জন মারা যায়; ২০১৯ সালে চকবাজারে চুড়িহাট্টার আগুনে মারা যায় ৭১ জন; একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে মারা যায় ২৭ জন; ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ নামের একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়; ২০২৩ সালের ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানেটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসে রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন ভবন ও মার্কেটের তালিকা করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে থেমে গেছে সবকিছু। ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা না মেনেই সবকিছু হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই। সেসব ব্যর্থতায় এবার বেইলি রোডের আগুনে পুড়েছে প্রায় অর্ধশত প্রাণ। আবার সক্রিয় হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। গঠিত হয়েছে তদন্তকমিটি। কিন্তু আগের মতো এ কমিটির সুপারিশও ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে, এটা ধরাই যায়। বেইলি রোডের এ ভবনটি পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিল, ভবনটি অগ্নি ও জননিরাপত্তার দিক থেকে খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভবনে সব নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতে হবে এবং দুটি সিঁড়ি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য তাদের তিনমাস সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ছয়মাস কেটে গেলেও ফায়ার সার্ভিস এখনো এর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, যা আমাদের কাছে খুবই হতাশাজনক। অগ্নিকাণ্ড যেকোনো সময়েই হতে পারে। অনেক বড় বড় শহরেও অগ্নিকাণ্ড হয়। কিন্তু রাজধারী ঢাকার মতো এত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কোথাও হয় না; এভাবে অসংখ্য মানুষ মারা যায় না। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়- এর পেছনে অনেক ধরনের গাফলতিও জড়িত। জানা যায়, বেইলি রোডের এ ভবনটিতে বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল। আর তাই ভবনটিকে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদনও দেওয়া হয়। তবে বাণিজ্যিক হিসেবে ভবন ব্যবহার করা এবং রেস্তোরাঁ পরিচালনা করা দুটি ভিন্ন কথা। ভবনটিতে যেখানে একটি মাত্র সিঁড়ি আছে, সেখানে এ ধরনের অনুমোদন কীভাবে আশা করা যায়? তবে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্ব কি শুধুই তাদের নোটিশ দেওয়া- আর কিছুই নয়? কর্তৃপক্ষের এমন অবহেলা আর একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা এখনো অন্ধকার যুগে বসবাস করছি। আমাদের কেউ কিছু বলার নেই- আমরা আছি বহাল তবিয়তে। বর্তমানে ঢাকা একটি অপরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে উঠছে দিন দিন। এই ঢাকাকে পুরোপুরি পরিকল্পিত নগর করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন আমাদের অবশ্যই করতে হবে। আর এ ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে পারলেই পরিকল্পিত নগর কিছুটা হলেও উন্নয়ন সম্ভব। একটি ভবন তৈরি করার আগে এবং ভবনকে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং চলাচলের জন্য সিঁড়ির সুব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ভবন যেন অগ্নিদুর্ঘটনার মধ্যে না থাকে, সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে- সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে।

ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তা আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। অথচ ভবন মালিকরা তা মানছেন না। এতগুলো অগ্নিদুর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আবাসিক ভবনে কেমিক্যাল রাখা বন্ধ হয়নি; যত্রতত্র রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। সবার চোখের সামনেই রাখা হচ্ছে এসব। কারো কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই যেন এদিকে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানেন, দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ হলেই তৎপর হয়ে ওঠে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শুরু হয় তাদের দৌড়াদৌড়ি, দেওয়া হয় একের পর এক সুপারিশ ও নির্দেশনা। কিন্তু ‘পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই আবার যেন থেমে যায় সবকিছু; ঝুলে যায় অধিকাংশ উদ্যোগ। এটা আমাদের দেশে এক ধরনের স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে না এলে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে- রাজধানী ঢাকা হবে একটি অগ্নিকুণ্ডের কারখানা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত