ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোডক্র্যাশ রোধে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

তরিকুল ইসলাম
রোডক্র্যাশ রোধে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

সড়কে মৃত্যুর মিছিলে নিহতদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। রোডক্র্যাশের মূল কারণ হচ্ছে- যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি, জনসচেতনতার অভাব, ওভারটেকিং, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। রোডক্র্যাশের হার কমাতে জনসচেতনতার পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি শক্তিশালী আইন ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর তথ্যানুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে সড়কে ৫ হাজার ৪৯৫টি রোডক্র্যাশে ৫ হাজার ২৪ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছে। ২০২২ সালে সড়কে ৫ হাজার ২০০ রোডক্র্যাশে ৪ হাজার ৬৩৮ জন নিহত হয়। ২০২১ সালে সড়কে ৫ হাজার ৪৭২ রোডক্র্যাশে ৫ হাজার ৮৪ জন নিহত হয় এবং ২০২০ সালে সড়কে ৪ হাজার ১৪৭ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৩৮ জন নিহত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রোডক্র্যাশ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, রোডক্র্যাশে সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ মারা যান। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। বিশ্বে তরুণরা যেসব কারণে বেশি হতাহত হন, এর মধ্যে রোডক্র্যাশ শীর্ষে। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে রোডক্র্যাশে ১৪ লাখ মানুষ মারা গেছেন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৪৭ হাজার। ২০০০ সালে বিশ্বে মৃত্যুর শীর্ষ ১০টি কারণের মধ্যে রোডক্র্যাশের স্থান ছিল দশম। ২০১৬ সালে রোডক্র্যাশে মৃত্যু অষ্টম স্থানে চলে এসেছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এটা সপ্তম স্থানে আসবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। এ ছাড়া সারা বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সে যারা মারা যান তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যায় রোডক্র্যাশ। অন্যদিকে রোডক্র্যাশে প্রতি বছর আহত হন ২ থেকে ৫ কোটি মানুষ। গরিব এবং মধ্যম আয়ের দেশে রোডক্র্যাশে মৃত্যু এবং আহত হওয়া পরিবারের জন্য দুর্বিষহ বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বড় বড় এবং পথচারী বহুল এলাকাগুলোতে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। ৮০টির বেশি বড় বড় শহরে পরিচালিত সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করা গেলে রোডক্র্যাশ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেলে ৪-৫ শতাংশ রোডক্র্যাশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যানবাহনের গতি যত বেশি কম হবে, পথচারীদের জন্য আহত ও মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি কম হবে। ৩০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। ৫০ কিলোমিটার ঘণ্টা বেগে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে বেপরোয়াভাবে দ্রুতগতিতে যানবাহন চালানোই রোডক্র্যাশের প্রধান কারণ। গতি নিয়ন্ত্রিত হলে রোডক্র্যাশ লাঘব হবে। বুয়েটের জরিপ বলছে, সারা দেশে যত রোডক্র্যাশ ঘটে এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ঘটে ২০ শতাংশ। শুধু শহরাঞ্চলের রোডক্র্যাশের মধ্যে ৭৪ শতাংশই ঘটে ঢাকায়। পাশাপাশি সড়কে চলতেই প্রতিনিয়ত দেখা যায়, হঠাৎই উচ্চশব্দ। দ্রুতগতির মোটরসাইকেল। কখনও হেলেদুলে আবার কখনও স্টান্ট করে প্রতিযোগিতার ভঙ্গিতে হেলমেট ছাড়ায় সড়কে চলতে দেখা যায় তরুণদের। শুধু শখের বশেই তাদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আর এতে চরম বিরক্ত ও আতঙ্কে থাকে পথচারীরা। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে রোডক্র্যাশ, তবু থেমে নেই এই বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা। এমন বিপজ্জনক খেলা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্টদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রোডক্র্যাশ প্রতিদিন ঘটছে এবং এতে যেভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে ক্রমেই ক্ষোভ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এ দুর্ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এ আইন প্রণয়ন করে। ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-এর ধারা ৪৪ এ মোটরযানের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ সড়ক বা মহাসড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির সড়কে মোটরযানের গতিসীমা নির্ধারণ বা পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে। কোনো মোটরযানের চালক সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত গতিতে বা বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালাতে পারবে না। কোনো মোটরযান চালক সড়ক বা মহাসড়কে বিপজ্জনকভাবে বা অননুমোদিতভাবে ওভারটেকিং করতে পারবে না বা মোটরযান চলাচলে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবেন না। সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমাতে হলে শুধু সরকারের একার পক্ষে দায়িত্ব নিলে হবে না। সাধারণ মানুষকেও নিজ দায়িত্বে সচেতন হতে হবে, সড়কে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, মদ্যপান বা নেশাজাতদ্রব্য সেবন করে যানবাহন চালানো যাবে না, মানসম্মত হেলমেট পরিধান করতে হবে, রাস্তা পারাপারের সময় উভয় দিকে খেয়াল রাখতে হবে, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও যাত্রীবোঝাই যানবাহন পরিহার করতে হবে। সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা থেকে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমার প্রত্যাশা, সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে শুধু আইন কার্যকর নয়, কঠোর নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আসুন, আমরা নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে নিজে নিরাপদে সড়ক ব্যবহার করি, সুস্থ থাকি, অন্যকে সুস্থ রাখি।

লেখক : তরিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন),

রোড সেইফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত