ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়

মো. জিল্লুর রহমান
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়

সম্প্রতি কিশোর গ্যাং অপরাধ নতুন করে আলোচনায় এসেছে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। ওই দিন ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করার জেরে নীরব হোসেন নামের ১৭ বছরের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে খুন করেন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। একইভাবে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ধূমপানে বাধা দেওয়ায় সালমান খন্দকার নামের এক যুবক কিশোর গ্যাং গ্রুপের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সন্ধ্যায় ১৮ বছর বয়সের যুবক সালমান খন্দকার এবং তার দুই বন্ধু একটি খালি মাঠে আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় জাহিদ (২০) তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপান করলে সালমান ও তার বন্ধুরা অন্যত্র সরে গিয়ে ধূমপান করতে বলে। এতে জাহিদ তাদের ওপর চড়াও হয় এবং ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল নিয়ে কাঠের ডাসা ও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি হামলা করে। সালমানকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সালমানকে মৃত ঘোষণা করে। জানা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে? ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। এরপর এসব গ্রুপের ব্যাপ্তি ক্রমেই বেড়েছে? ১৫-২০ বছর বয়সি কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে? বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ বিগত কয়েক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বার বার নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে আলোচনায় এসেছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব কিশোর গ্যাং বাহিনীগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব বাহিনী এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এগুলো এখন সমাজ ব্যবস্থার গলার কাঁটা। শুধু রাজধানীতে নয়, বড় বড় শহর ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে এসব কিশোর গ্যাং বাহিনী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানী ও দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোর-তরুণদের নিয়ে এমন অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। যারা মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানিসহ নানান অপকর্মে যুক্ত। এসব চক্রের সদস্যদের বড় অংশ কিশোর হলেও নেতাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৮ বছর। চক্রের সদস্যরা তাঁদের ‘সিনিয়র’ বা ‘বড় ভাই’ বলে ডাকে। এসব চক্রের নেতাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত অথবা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছে, পুলিশের সূত্রে ঢাকায় গাংচিল বাহিনীর মতো অন্তত ৮০টি বাহিনীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, শুধু টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত। এসব অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, অনেকেই বস্তিতে থাকে। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। বাহিনীগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয় পান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। যদিও কয়েকজন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পুলিশ ২০২২ সালের শেষ দিকে সারা দেশের ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তাতে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি এবং এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি, চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি এবং মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরো অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরা শুধু ভয়ংকর অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট। কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনে সর্বপ্রথম এর কারণ চিহ্নিত করা দরকার। অনেকে বলছেন পারিবারিক সুশিক্ষা ও নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এর জন্য মূলত দায়ী। এক্ষেত্রে পরিবারকে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে। পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে পিতা-মাতাকে। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় সময় কাটায় এ ক’টি বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব। এর বাইরে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আসলে বর্তমান সমাজে পরিবারের দায়িত্ববোধ কমে যাওয়ায় এবং এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখায় এর প্রতি সদস্যদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাবা-মা-ভাই বোন কেউই কারো প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা যথাযথ দায়িত্ববোধ অনুভব করছে না। বস্তুবাদী এ সমাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বাবা-মা উভয়েই চাকরি ও অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছে না। ফলে ছেলেমেয়েরা অভিভাবক বা বড়দের পরোয়া করছে না। সামান্য ব্যাপারেই পরিবার ব্যবস্থায় ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করছে এবং পরবর্তী সময়ে এগুলো তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব ও মানবতা বোধের পরিচয় দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবার থেকে পাচ্ছে না মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা। বাবা-মা উভয়েই চাকরিজীবী হওয়ায় তারা অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও সন্তানের সুশিক্ষায় নজর দিতে পারছে না। ফলে সন্তানরা গৃহশিক্ষক কিংবা গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে থেকে নৈতিক মূল্যবোধ তথা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেকের সন্তান বিপথে চলে যাচ্ছে। যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে। মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। পরিবার থেকেই সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয়। এজন্য একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক নৈতিক সুশিক্ষা। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা- এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে। বর্তমানে পরিবার ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চরিত্রহীনতার দিকটি বিশেষভাবে ফুটে উঠে। মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে ধর্মীয় দিকটির গুরুত্বকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করেন। অথচ পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসার কথা। শুধু মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য লোক দেখানো প্রচারণা চালালে হবে না, বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য চরিত্র গঠনে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ ও যুবসমাজকে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। যা অসুন্দর, দৃষ্টিকটু বা রুচিহীন, সে সবকে ইসলাম বা কোনো ধর্ম কখনো সমর্থন করে না। বরং সেগুলোকে বর্জন করতে উৎসাহী করতে হবে। মানুষকে পরিপূর্ণরূপে চরিত্রবান করে তুলতে ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। মূলত কিশোর গ্যাং গ্রুপ শহর, বন্দর ও দেশের সর্বত্র অলিগলিতে চায়ের দোকান বা বিশেষ কিছু স্থানে অবস্থান নিয়ে আড্ডা জমায়। তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত সংগঠিত হচ্ছে নানা অপরাধ। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চুরি, ইয়াবা সেবন, ছিনতাই, মদ বিক্রি ও সেবন, জিম্মি রেখে টাকা আদায়সহ ভয়ংকর সব অপরাধ করে বেড়ায় কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসী গ্রুপ। বখাটেপনা বা কিশোর গ্যাং অপরাধ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার উপায় না থাকায় অভিভাবকরা চরম শঙ্কিত। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর আইনের প্রয়োগ করলেই চলবে না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে সরকারের উঁচু স্তর থেকে বিষয়টি তদারকি করতে হবে। তবেই সমাজ থেকে কিশোর অপরাধের মতো গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত