উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নারী এক হিরণ্ময় চরিত্র

নুরুন্নাহার মুন্নি

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম ভাতের হাঁড়িতে কিংবা সাজানো গোছানো নাস্তার টেবিলে আমরা যার ছবিটা মনে মনে দেখতে চাই বা দেখি অথবা প্রত্যাশা করি তিনি হচ্ছেন একজন মা কিংবা একজন স্ত্রী অথবা একজন বোন। সারা দিন যাপনের মধ্য দিয়ে রান্নাঘরের চিত্রপটে যুগের পর যুগ আমাদের চিন্তা চেতনাকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, আজও আমরা সেটাই প্রত্যাশা করি এবং নারীরা তাদের ধৈর্য্য, দক্ষতা এবং ক্ষমতার বিশেষ গুণে গুণান্বিত বলেই শুধু পরিবার নয়, অফিস আদালতেও তাদের বুদ্ধি এবং মেধার সাক্ষর রেখে চলেছেন বিভিন্ন প্রতিকূলতা ছাপিয়েও। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানির বোর্ডরুম পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করার মতো। সেকারণেই ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’- প্রবাদটি এখনও বিশেষভাবে আমাদের সর্বস্তরে প্রচলিত। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা আমরা কম বেশি সবাই শুনেছি ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো।’ সক্ষমতার আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার নারী সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, এবং রাজনীতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি পরীলক্ষিত হলেও তা পুরুষ সমাজের অর্জিত সাফল্যের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। কঠোর সাধনা এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে গিয়ে পিছিয়েপড়া নারীদের সংখ্যাও কম নয়, এর পেছনের গল্পে থাকে জানা অজানা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানামুখী চাপ এবং নারীদের ঘরবন্দি করে রাখার সেকেলে মানসিকতা। আমরা দেখতে পাই ‘সমতা অর্জনের জন্য নারীদের সংগ্রামের গল্প কোনো একক নারীবাদী বা কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, যারা মানবাধিকার সম্পর্কে যত্নশীল তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার অন্তর্ভুক্ত।’ সুতরাং পরিবারকে হতে হবে সর্বপ্রথম সেই সমতা অর্জনের প্রধান অনুপ্রেরণা এবং প্রধান সমবায় কেন্দ্র। সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৬০ কোটি নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। ইতালি, ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রেও ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে সেখানে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার অগ্রগতি হলেও পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, আধুনিক পদ্ধতিতে যৌতুক আদায়, চাকরিক্ষেত্রে নানা কায়দায় চাপ প্রয়োগে নারীদের অনৈতিক এবং অসামাজিক কাজে বাধ্য করা, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত লেবাসধারী কিছু পিশাচ শ্রেণির শিক্ষকদের উপর কন্যাসন্তানের অভিভাবকদের আস্থাহীনতা, গ্রামীণ সমাজে বেড়ে ওঠা পরিবারের ভেতর আড়াল আবডালে এখনও বাল্যবিয়ের প্রবণতা এ দেশের শিক্ষিত নারী এবং নারীদের দারিদ্র্যসীমর নিচে ও নারী পুরুষ সমতা অর্জনে প্রধান প্রধান অন্তরায়। ধর্মীয় গোড়ামীকেও বাদ দেয়া যায় না। সেই আদিকাল থেকেই নারীদের দুর্বল এবং সন্তান উৎপাদনের মেশিন হিসেবে নিচু মানসিকতার বীজ ডিজিটাল যুগে এসেও চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন ধর্মে পৈত্রিক সম্পত্তি বণ্টন নিয়েও অসম স্পষ্ট বক্তব্য পরিবার নিয়ম মনে করে মেনে আসছে বিধায় সেই শৈশবকাল থেকে পিতামাতা কন্যাসন্তান আর পুত্রসন্তানের মাঝে ভালোবাসা এবং সম্পদ বণ্টনেও কঠোর হয়ে ওঠেন। যদিও ডিজিটাল যুগ পেরিয়ে আমরা স্মার্ট যুগে প্রদার্পণ করছি তবুও ধর্মীয় গোড়ামীর নিকট কখনও কখনও হেরে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা, নীতিবোধ। আর এভাবেই অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে এখন অনেক অনেক নারী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান চেয়ারগুলোতে, উন্নয়নের বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের সাফল্য বিশেষভাবে ঈর্ষণীয় হলেও নারী সাফল্য পুরুষদের সহ্য না করার প্রবণতা বিদ্যমান এবং এক প্রকার দম্ভ ও অহংকারী ভাব তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে, তাদের এহেন শত্রুভাবাপন্ন আচরণ প্রায়শই আমাদের চোখ বিদ্ধ করে। ‘কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’- কাজী নজরুল ইসলামের অমর সেই বাণী কতটুকু বুদ্ধিদীপ্ত সমাজে প্রভাব ফেলতে পেরেছে বা পারবে অদূর ভবিষ্যতে সেটাই দেখার বিষয়। উন্নয়শীল রাষ্ট্রে মসজিদের পাশে গড়ে ওঠা পার্লার আর মন্দীরের পাশে লুকানো শ্রীঘরের জমজমাট বাণিজ্য নিয়ে নারীদের বংশ নির্বংশ করতে চড়াও হওয়া জাতি নারীদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে অপারগ অথচ গোপন আস্তানাগুলোতে গৃহবধূ কিংবা স্কুলছাত্রীদের গণধর্ষণের শিকার করা সংবাদে টেলিভিশন আর পত্রিকার পাতাগুলো আমাদের সমাজের নারীদের লজ্জিত করে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া সত্ত্বেও সতর্ক ও শোধরানো মানসিকতা তৈরি না হওয়া কতিপয় পুরুষ অগণিত নারীর জীবন হন্তারকের ভূমিকায়! পৃথিবীর সব কাজের যেমন ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক আছে তেমনি নারী পুরুষের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বিন্যাসেও ব্যতিক্রমী মানসিকতার মানুষে ভরপুর। নারী পুরুষ উভয় শ্রেণিতেই ভালো মন্দ জড়িয়ে আছে। সমাজে স্বাধীনতার নামে উগ্রতা, রাষ্ট্র প্রদত্ত নারী সুবিধা আদায়ের জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়া কিছু নারী সমাজকে কলুষিত করছে। এরা অপরাধীর তালিকায় দৃষ্টান্ত হতে পারে কিন্তু এরা সমগ্র নারী সমাজের অগ্রগতির অন্তরায় হতে পারে না। ২০২৪ সালের বাংলাদেশে আশার কথা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের আশানুরূপ সাফল্য চোখে পড়ার মতো একইভাবে কর্মসংস্থানেও কিছুটা বেড়েছে নারীদের অংশগ্রহণ তবে যথেষ্ট নয়। কর্মসংস্থানেও যথাযথ সুযোগ প্রদান করে এই লিঙ্গ বৈষম্য একেবারে বন্ধ করা উচিত। শুধুমাত্র ৮ই মার্চ অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই নয়, সমসুবিধা আদায়ের আন্দোলনে নারীদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক হিসেবে পুরুষদেরও পাশে দাঁড়ানো উচিত। কমিউনিস্ট ও নারী অধিকার কর্মী ক্লারা জেটকিন শ্রমিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা। ১৯০৮ সালের এই দিনে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫০০০ নারী নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিল। মূলত উদ্দেশ্য ছিল দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পরিণত করার উদ্যোগ। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে কর্মজীবী নারীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ ধারনার প্রস্তাব পেশ করেন। ওই সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারীর সবাই তার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেন। তারপর ১৯১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে এই ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অগ্রযাত্রায় আমাদের নারীশক্তি কাজে লাগাতে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সাহসী উদ্যোগ। শুধুমাত্র দিবসের বাণীতে আটকে না রেখে সমাজে শিক্ষিত স্বনির্ভর এবং দায়িত্বশীল নারীদের সর্বস্তরে মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে নারীদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক হিসেবে পুরুষদেরও বন্ধুসুলভ উদ্যোগী ভূমিকা রাখা একান্ত প্রয়োজন। তবেই সম্ভব- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে স্মার্ট দেশ হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করা, ১১৩তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রত্যাশার ঘরে আসুক ইতিবাচক যোগফল।