৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের শক্তি, উৎসাহ আর প্রেরণা জোগায়

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর বাঙালিরা অনুভব করে, তারা পাকিস্তান নামক নতুন ঔপনিবেশ পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানি শাসনের শুরুতেই ভাষার প্রশ্নে একাত্ম্য হয় বাঙালি। বায়ান্ন পেরিয়ে চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টির পথ বেয়ে আসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। প্রবল গণঅভ্যুত্থানে কেঁপে ওঠে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের মসনদ গণঅভ্যুত্থানের বিরূপ প্রভাবে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ওই পদে আসীন হন। তিনি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ এক ঘোষণায় পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। ৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি।

৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ ওই অধিবেশনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারে, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।

এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার কথা উল্লেখ করেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন এইদিন। মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন।

১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ভাষণে বাংলার মানুষের মুক্তির কথা বলছেন, বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে সাক্ষর রেখেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার। তিনি তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবার কথাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত বিশ্বের আর কোনো নেতা পারেননি।

তিনি ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস।

নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ভাষণে শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।” ভাষণের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” এই ভাষণটিই মূলত বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ভাষণ।

ঐতিহাসিক সেই ভাষণের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি তারবার্তা পাঠান। ইপিআরের ওয়ারলেস বার্তায় প্রচার করা হয় তার স্বাধীনতার ঘোষণা। দেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করেন বাংলার দামাল ছেলেরা। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশকে হানাদার মুক্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নেয় ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, সাংবাদিক-শিল্পীসহ সব শ্রেণির মানুষ। দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে আসে বিজয়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে জানান দিল ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাঙালি স্বাধীনতা পেলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ হয়। নিষিদ্ধ হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নাম মুছে দিতে উদ্যত হয় স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। নতুন প্রজন্মকে শেখানো হয় মিথ্যা ইতিহাস। তবে, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা বর্তমান পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কারণে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস সামনে এসেছে। আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সংবিধানের পঞ্চম তপসিল দ্বারা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু, সংবিধানের ৭(খ) অনুযায়ী, সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের একটি অপরিবর্তনযোগ্য বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে পঞ্চম তপসিলে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি আমাদের সংবিধানের একটি অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় অংশে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে প্রথম “রাজনীতির কবি বা পয়েট অব পলিটিক্স” উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল এই নিউজউইক ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন পর্যন্ত মোট ১৩টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য (মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। মানবসভ্যতার সম্পদগুলো ধরে রাখতে প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ২০১৭সালে ৭৮টি দেশের ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের প্রত্যক্ষদর্শী স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রাপ্ত দেশের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। কবিতা লিখেছেন ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে, অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা; কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।’ নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় বঙ্গবন্ধুর আগমনকে রবীন্দ্রনাথের দৃপ্ত পায়ে হাঁটার সঙ্গে তুলনা করে এই ভাষণকে কবিতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। ঐতিহাসিক আজকের এইদিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আমাদের শক্তি, উৎসাহ আর প্রেরণা জোগায়। ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যেভাবে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, তেমনি করে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, নৈরাজ্য, ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।