ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৭ই মার্চের ভাষণ এখনো প্রেরণা

মহান মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি
৭ই মার্চের ভাষণ এখনো প্রেরণা

৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এখনো আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি আজও প্রাসঙ্গিক। আমাদের পথচলার নির্দেশনা। ’৪৮ থেকে শুরু করে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে এদেশের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উদ্বেলিত মহাসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজদীপ্ত উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা, যা প্রজ্বালিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই দাবানলের, যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা।

১৯৭১-এর ৭ থেকে ২৫ মার্চ এ ১৮ দিনে এ ভাষণ বাংলাদেশেরে ৭ কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি এসেছিল ২৬ মার্চের প্রথমে প্রহরে। বঙ্গবন্ধু বাংলাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ার। তিনি এক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে তিনি তৈরি করবেন দক্ষ মানবসম্পদ আর যারা হবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সুশিক্ষিত নাগরিক। একটি সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে ওঠেছিল পুরো জাতি। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের, যেদিন তিনি দেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা। এটি ছিল একটি এপিক ভাষণ; এ ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করলেন তিনি। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তাই তো বাংলার দামাল ছেলেরা ৯ মাস যুদ্ধ করার মনোবল পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এ তেজদীপ্ত মুক্তির বাণী শোনার জন্য ওইদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাস-ট্রাক-লঞ্চণ্ডট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে সয়লাব হয়ে যায়, তখনকার ঘোড়দৌড়ের এ বিশাল ময়দান। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি তুলে ধরেছিলেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন; অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন- যদি যুদ্ধ হয়, তবে বাঙালিরা যেন বর্ষাকালকে বেছে নেয় যুদ্ধের জন্য। তার এ বক্তৃতার তুলনা করা হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের সঙ্গে। আর তুলনা করা চলে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্সে ভাষণ দেওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং যেমন বর্ণবাদমুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি জাতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য জাতিকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন; বঙ্গবন্ধুও তার ৭ মার্চ ভাষণে ঠিক তেমনই বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিকে জাগ্রত হতে বলেছিলেন, সংগ্রাম করতে বলেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন তার ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন; বঙ্গবন্ধুও ৭ মার্চের সেই অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণের দ্বারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ও মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্ন একই সূত্রে গাঁথা। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ সেটিরই প্রতিরূপ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি মহাকাব্যিক আবেদন মহাকালই বিচার করবে। লাখো জনতার সামনে একটি অনুপম কবিতার মতো, স্ফুলিঙ্গের মতো ও সাগরের উত্তাল জলরাশির মতো সত্য সুন্দর শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। এ ভাষণের ব্যঞ্জনা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব সেদিন যারা কাছে বসে শুনেছেন, তারাই বুঝতে পারবেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এ ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি যথার্থই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা- ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’ সত্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এ ভাষণের সুর অনুসরণ করেই এক নতুন রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এরই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। ‘বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা; যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কণ্ঠ বজ্রকঠিন। তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। তার সাহস এবং অনুপ্রেরণা শক্তি তাকে এ সময়ের অনন্য সেরা মানবে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত