ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকায় ধুলোর অত্যাচার ভয়াবহ

মুসা আল হাফিজ
ঢাকায় ধুলোর অত্যাচার ভয়াবহ

ঢাকায় ধুলোর অত্যাচার এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাতাসে দুর্ভোগের বিস্তার। দূষণের তীব্রতায় নাকাল ঢাকার পরিবেশ। চারদিকে ধুলো আর ধুলো। কোথাও বের হলেন। ঘরে ফিরে মুখ ধোবেন। মুখ থেকে ঝরেপড়া পানি দেখবেন অনেকটা কালো। ময়লার কারণে। পোশাকে ধুলো, শরীরে ধুলো। ঘরের ভেতরেও আসবাবপত্রে ধুলোর স্বেচ্ছাচার। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতিতেও ধুলো, সেগুলো নষ্ট হচ্ছে দ্রুত। নানা রকম খাবারের সঙ্গে থাকছে ধুলো। শ্বাস গ্রহণে ধুলো। ধুলো নিয়ে আসছে বহু রোগ, বহু জটিলতা। জীবন ও শক্তির কোলাহলে স্পন্দিত রাজধানী শহরটির ভেতরে-বাইরে নানা হুমকি। তার মুখর বাহ্যিক ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা জখম ও প্রাণঘাতী অসুখ কম নয়। ঢাকা মহানগরী অনেক পীড়ায় ভুগছে। কিন্তু ধুলো পরিণত হয়েছে তার শ্বাসকষ্টে। দ্রুত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ এবং ভারী যানবাহন ভয়ঙ্কর ধুলো দূষণের আবর্তন তৈরি করেছে, যা শুধু শহরের সৌন্দর্যকে লাঞ্ছিত করে না, বরং এর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, জীবনের প্রতিশ্রুতি ও স্বাভাবিক মঙ্গলের বিরুদ্ধে অব্যাহত হুমকি হয়ে উঠেছে। ধুলো ঢাকা এই শহর ভেতরে বিশৃঙ্খল। প্রায়ই আচ্ছন্ন থাকে এক পরাবাস্তব কুয়াশায়। এটি কোনো প্রাকৃতিক কুয়াশা নয়; এ হচ্ছে ভেতরের বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নেওয়া বিশাল ধূলি-মেঘের অভিশাপ। দায়িত্বহীন হাত দিয়ে মাটি খুঁড়া হয় এখানে, পাথর চূর্ণ করা হয় এবং সিমেন্ট মিশিয়ে বাতাসে সূক্ষ্ম ধুলোর মেঘ পাঠানো হয়। এসব করা হয় সড়ক উন্নয়ন, স্থাপনা তৈরি, হাইরাইজ বিল্ডিং বানানো ইত্যাদির লাগামহীন অব্যস্থাপনার মধ্যদিয়ে। দিনে সবাই যানজটে নাকাল। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি লড়াই বাকি। নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধুলো-বোঝাই বাতাসের সঙ্গে ঢাকার বাসিন্দাদের যুদ্ধ করতে হবে। এখানে তারা জিতছেন কম। ফলে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং অন্যান্য ফুসফুসের ব্যাধিগুলোর সঙ্গে শ্বাসকষ্টের অসুখগুলো ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এ যুদ্ধের সবচেয়ে অসহায় শিকার বয়স্ক এবং শিশুরা। তাদের দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং শ্বাসযন্ত্রের সিস্টেমগুলো অদৃশ্য হুমকিতে জেরবার। ধুলো দূষণের আক্রমণ মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতিই চোখ রাঙাচ্ছে না, বরং এর ফলে ঢাকার পরিবেশের গোটা ফুসফুস এখন অবরুদ্ধ। সূক্ষ্ম ধূলিকণা গাছের পাতা এবং পৃষ্ঠের উপর বসতি স্থাপন করছে। সালোকসংশ্লেষণকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং শহরের সবুজ আত্মাকে পদাঘাত করছে। জলাশয়গুলো এই সংকটের ধাক্কা বহন করতে পারছে না। কেন না, ধুলোবোঝাই বৃষ্টির পানি নদী ও হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সম্ভাব্য জলজ বাস্তুতন্ত্র এবং পানির গুণমানকে ক্ষুণ্ণ করছে। এই সংকট মোকাবিলার জন্য আমরা কিছুই করিনি, তা নয়। অপর্যাপ্ত প্রবিধান আছে আমাদের। যদিও তার প্রয়োগের অভাব পর্যাপ্ত। কিছু নির্দেশিকা আছে বটে, সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয় প্রতিনিয়ত। সেগুলোর অনুসরণের অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালোভাবে অনুসরণ না করা। নির্মাণ প্রকল্পগুলো যথাযথ ধূলিকণা প্রশমনের ব্যবস্থা ছাড়াই এগিয়ে চলে। যানবাহনগুলো দক্ষ নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াই রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ায়। ঢাকার ধুলোসমস্যা নিয়ে কান্নাকাটি কম হয়নি। আমাদের দরকার স্পষ্ট করণীয় নির্ধারণ, করণীয় বয়ান। এক্ষেত্রে দুই ধরনের কর্মসূচির প্রস্তাব করব। ১. অস্থায়ী ব্যবস্থা ও ২. স্থায়ী ব্যবস্থা।

অস্থায়ী ব্যবস্থা : ধুলো নিয়ন্ত্রণ স্প্রে : নির্মাণক্ষেত্রে বালি, ইট, পাথর, অন্যান্য নির্মাণ উপকরণসহ খনন করা মাটি যত্রতত্র রাখা হচ্ছে। ফলে ধুলোবালু বাতাসে উড়ছে। সেখানে ধুলো নিয়ন্ত্রণ স্প্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কাঁচা রাস্তা এবং উচ্চ ধূলিকণাকবলিত এলাকায়ও তা প্রয়োগ করা উচিত। স্প্রেগুলো ধূলিকণাকে দমন করে এবং বাতাসে তাদের বিচ্ছুরণ রোধ করে। এটি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয় এবং অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে তা পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা রাখবে।

ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট : পিক আওয়ারে ভারী যানবাহন সীমিত করতে হবে। যানবাহনের জন্য কঠোর নির্গমন মান প্রয়োগ করতে হবে। এটি যানবাহন চলাচলের ফলে ছড়ানো ধুলোর মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। জোড়-বিজোড় যানবাহন স্কিম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্লিনার ফুয়েল ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত।

রাস্তা কার্পেটিং এবং পানি দেওয়া : নিয়মিত কাঁচা রাস্তা ভিজানো, পাকা রাস্তায় পানি দেওয়া জরুরি। ধুলো দমন করার জন্য পানির ট্রাক ব্যবহার করা যেতে পারে। রাস্তায় কার্পেটিং প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। যেসব রাস্তায় কার্পেটিং উঠে গেছে, নুড়ি পাথর সরে গেছে, খানা-খন্দ এখানে-ওখানে, সেসব রাস্তা ধুলোবালুর উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে। এসবের যথাযথ সংস্কার জরুরি। রাস্তা পাকাকরণ ও টেকসই কার্পেটিং এবং রাস্তায় পানিদান ধূলিকণার বিস্তার কমাতে পারে।

সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান : ধূলিকণার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানো আবশ্যক। নিজেদের রক্ষার জন্য মানুষ কী করতে পারে, তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদি আচরণগত পরিবর্তনের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যার মধ্যে মাস্ক ব্যবহার করা, ধূলি বিস্তারের সময় বাইরের কার্যকলাপ এড়ানো এবং জানালা বন্ধ রাখা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।

অস্থায়ী সবুজ বাধা : যেসব এলাকা বেশি ধুলোপ্রবণ, সেসব এলাকায় দ্রুত বর্ধনশীল গাছপালা লাগাতে হবে। এটি অস্থায়ী সবুজ বাধা হিসাবে কাজ করবে। বৃক্ষ-তরুলতা ধূলিকণা আটকাতে পারে এবং আশপাশে বাতাসের গুণমান উন্নত করতে পারে।

রাস্তার পাশে ঘাস-গাছ : সড়ক- মহাসড়কে কার্পেটিং করা অংশের বাইরে ঘাসহীন যে অংশ আছে, যানবাহন চলাচলজনিত সৃষ্ট বাতাসে সেখান থেকে চারধারে প্রচুর ধুলো ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার পাশে তাই গাছ লাগাতে হবে, ঘাস লাগাতে হবে।

স্থায়ী ব্যবস্থা : ১. নগর পরিকল্পনা এবং নকশা: সবুজ স্থান, বাফার জোন এবং দক্ষ ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নগর পরিকল্পনা কৌশলগুলো সংশোধন করা উচিত। সঠিক জোনিং এবং নকশার মাধ্যমে আবাসিক এলাকাগুলিকে শিল্পাঞ্চল থেকে আলাদা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে বাসিন্দাদের ওপর দূষণের প্রভাব কমানো সম্ভব।

২. অবকাঠামো উন্নয়ন : ভালো পাকা রাস্তা, দক্ষ নিষ্কাশন ব্যবস্থা, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দরকার। এখানে কাজ করলে ধুলোর আধিপত্য উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। তবে সঠিকভাবে ডিজাইন করতে হবে এবং অবকাঠামোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যা রাস্তার উপরিভাগ থেকে ধুলোর স্বৈরাচার দূর করতে পারে।

৩. নির্মাণ প্রবিধান : বাধ্যতামূলক ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নির্মাণ কার্যক্রমের জন্য কঠোর প্রবিধান বাস্তবায়ন এবং তার প্রয়োগ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পৃষ্ঠ ভেজা এবং ধুলো সংগ্রাহক যন্ত্রের ব্যবহার।

৪. সবুজ উদ্যোগ : শহরজুড়ে বন বিস্তারের বিকল্প নেই! বৃক্ষবৃদ্ধিতে সরকারকে কাজ করতে হবে। জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অধিকমাত্রায় সবুজের উপস্থিতি জীবনের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি করে। বৃক্ষ, তরু-লতা প্রাকৃতিক ধুলোর ফিল্টার হিসাবে কাজ করে এবং সামগ্রিক বায়ুর গুণমান উন্নত করে। ঢাকাকে সবুজের প্রাধান্যে ঢাকতে পারলে ধুলোসমস্যার মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে।

৫. টেকসই পরিবহন : পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমে বিনিয়োগ, সাইক্লিং লেনের প্রচার এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনকে উৎসাহিত করা জরুরি। এর মাধ্যমে যানবাহনের ধোঁয়া নির্গমন কমতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে শহরে ধূলিকণার মাত্রা হ্রাস হতে পারে।

৬. এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং : ধুলোর মাত্রা ট্র্যাক করা এবং ধুলোর উৎসগুলো বোঝার জন্য শহরজুড়ে একটি ব্যাপক বায়ু গুণমান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা উচিত। রিয়েল-টাইম ডেটার সহায়তা নেওয়া দরকার। যা নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো জানাতে পারে। সমস্যা সমাধানে কার্যকর হস্তক্ষেপে তার সুবিধা কাজে লাগবে।

৭. গবেষণা এবং উদ্ভাবন : ধুলো কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল বিকাশের উপর মনোযোগ বাড়াতে হবে। গবেষণা উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দিতে হবে। টেকসই সমাধানের চিন্তাগুলোকে প্রণোদিত করতে হবে, যা উন্নত ধুলো নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, উপকরণ এবং নগর পরিকল্পনার কৌশল অধ্যয়নকে অগ্রসর করবে। ঢাকা মহানগরী ধূলিকণা সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ হতে পারে না। ব্যর্থ না হওয়ার জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পদ্ধতি। দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ও স্থায়ী পদক্ষেপে সঙ্গে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য অস্থায়ী ব্যবস্থাকেও সমন্বিত করতে হবে। আপাতত ধুলো নিয়ন্ত্রণ স্প্রে, পানি দেওয়া, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা এবং সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান দ্রুত সমাধানের দিকে এগিয়ে নেবে। নগর পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং টেকসই অনুশীলনের যথার্থতা ধুলোর অত্যাচারের বিপরীতে বাসযোগ্য, স্বাস্থ্যকর ঢাকা অর্জনের চাবিকাঠি। কঠোর বিধি-বিধান ও তার প্রয়োগ এবং সব স্টেকহোল্ডারের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগানো একান্ত জরুরি। এই ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন শুধু সরকারের কাজ নয়। সরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত, পরিবেশ সংস্থা এবং জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।

লেখক : কবি, গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত