টেকনোলজি যুগে যুগে

মারুফুর রহমান খান

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা যারা ৯০-এর দশকের বেড়ে ওঠা প্রজন্ম, তারা নিজেদের অনেক দিক থেকেই ভাগ্যবান দাবি করতে পারি। এজন্য যে, আমরা এমন একটি প্রজন্ম যারা সাদাকালোর জগৎ দেখেছি এবং সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। সহজ কথা দিয়ে শুরু করি। আমাদের সময় ছিল সিঙ্গেল ডিজিট টিভি চ্যানেলের যুগ। মানে বিটিভি, তাও আবার সাদাকালো। টিভি সবার বাসায় ছিলও না। আমরা পাশের বাসায় টিভি দেখতে যেতাম। যখন ম্যাক গাইভার, দি এ টিম দেখতে বসতাম, তখন টিভি ঝিরঝির করলে একজন চলে যেতাম বাঁশ ঘুরাতে। মানের বাঁশের আগায় এন্টেনা লাগানো থাকত। আর মনে মনে দোয়া পড়তাম, বাইরের জন চিল্লাইয়া বলতো, হইছে? ভেতরের জনরাও সমস্বরে রিপ্লাই দিতো, হয় নাই, হইছে, আরে হইছিল, আবার আগের জায়গায় নে। আহা!, সেটাই এক অনুভূতি, যা তখন বুঝি নাই, এখন বুঝি। তখন আমরা দল বেঁধে সিনেমা হলে যেতাম। সাদাকালোর যুগ থেকে আমরা আংশিক রঙিনে প্রবেশ করি। ফ্রন্ট স্টল, রিয়ার স্টল, ব্যালকনি ইত্যাদি নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই তখন থেকে। ওহ!, আজকের যারা সিনেপ্লেক্স প্রজন্ম, তাদের কাছে এই নামগুলো হিব্রু। লড়াকু সিনেমার টিকিট যখন অনেক কষ্টে জোগাড় করে দেখি সিট ফ্রন্ট স্টলের, মানে একেবারের সামনে সিট, যা থেকে পর্দার দূরত্ব প্রায় এক হাত বা একটু দূরে। আর ছিল পোস্ট অফিস, চিঠি নিয়ে আসত পোস্টম্যান। শুধু চিঠিই না। বেশ কিছু কিশোর পত্রিকা এনরোল করেছিলাম, যা আনার একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিস। আমার কৈশোরে মোবাইল ছিল না, আমাদের বাসায় ও কোনো ল্যান্ড ফোন ছিল না। যাদের বাসায় ছিল, তারা সেটে তালা দিয়ে রাখত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি, হলের ছাত্রদের লাইন দিয়ে কয়েন ফেলে বিশালাকার ফোন বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। পরবর্তীতে, আসল এসটিডি বুথ। এক সময় আমরা প্রবেশ করলাম মোবাইলের দুনিয়ায়। মটোরোলার সেই সিডিএমএ’র ফোন যা ছিল সাধারণের স্বপ্নের ব্যাপার। পরবর্তীতে আমাদের হাতে আসল নোকিয়া যা কি না মাস পিপলকে কানেক্ট করে ফেলেছিল। আর মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছিল মোবাইল ফোন রিচার্জ এর দোকান। আর হ্যাঁ, আমাদের সময় জনপ্রিয় ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। বিকালে আমরা নানা বই পড়তে যেতাম। আরেকটি জিনিস ছিল, তা হলো ক্যামেরা। ক্যামেরার রিল। মনে পড়ে ৩৬টা ছবি যাতে ওঠে, সেজন্য বিশেষ কায়দা করে রিল লাগাতে হতো, যদি না পারতাম তাইলে বন্ধুদের বকা একটাও মাটিতে পড়ত না। আর ছিল ব্যাংকিং। আব্বার সঙ্গে একবার ব্যাংকে গেলাম চেক দিয়ে টাকা তুলতে। একজন সোনালি রংয়ের একটি কয়েন দিল, আব্বা আমাকে বসিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আসলে ওটা ছিল সিরিয়াল নং। আমার মনে আছে, পাক্কা ২ ঘণ্টা বসেছিলাম আমি। আর আমি কয়েনটি এমনভাবে ধরে রেখেছিলাম যে, ওটাই টাকার চাবি। এতক্ষণ যে কথাগুলো বল্লাম, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ভাবছে যে, এগুলো গাল গল্প। টিভি দেখতে বাঁশ ঘুরাইতে হবে কেন? যেখানে ডিশ, ওয়াইফাই কানেকশন, হালের আকাশ, ইউটিউব এতগুলো অপশন বিদ্যমান। কল করতে হলে কারো বাসায় যেতে হবে কেন? যেখানে মোবাইল আছে হাতের মুঠোয়। পোস্ট অফিস! সে আবার কী? চিঠি লিখব কেন? যেখানে আছে ই-মেইল, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, লিঙ্কড ইন আরো কত কী! বই পড়তে পাব্লিক লাইব্রেরিতে যাব কেন? যেখানে গুগল সার্চে হাজারো বইয়ের পিডিএফের ভান্ডার। সেই নোকিয়াও আজকে ইতিহাস, কারণ সে নিজেকে পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত করে নাই। ক্যামেরা, ফিল্ম, ফুজি, কোডাক আজকে ইতিহাস। ক্যামেরা চলে গিয়েছে মোবাইলে। আধুনিক ডেস্কটপ-ল্যাপটপ-এর কাজও এখন হয় মোবাইল ফোনে। ই-মেইল থেকে শুরু করে ডকুমেন্ট লেখার সব কাজই এখন মুঠোফোনেই করি। অফিসের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজেক্টের গ্রুপের আপডেট-মিটিং মাইন্যুঈটস ও পাই হোয়াটাসাপ গ্রুপে। আর ব্যাংকিং। সোনালি কয়েনের দিন তো আর নেই। ম্যানুয়াল লেজারের দিন নেই। এটিএম এলো। আর এখন? মুঠোফোনেই সেরে ফেলি তা। ফান্ড ট্র্যান্সফার থেকে শুরু করে মোবাইল রিচার্জ, উইটিলিটি বিল প্রদান, সবই তো হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ্সে। লেটেস্ট টেকনোলজি হিসেবে আসছে কিউ আরে কোডে ট্রান্সজেকশন। চেক বই দিয়ে আমি কবে টাকা তুলেছি তা ভুলে গেছি। টাকা জমা দেয়ার জন্যও আছে রিয়েল টাইম সিডিএম (ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন), যাতে কি না গ্রাহকের শাখায়ও আসতে হচ্ছে না এবং নেই কোনো টাইমণ্ডএর সীমাবদ্ধতা। অফিসের অভ্যন্তরীণ কার্যাদি সম্পন্ন করতেও এখন চলে এসেছে ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যা ডিএমএস নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে স্মার্ট ওয়ার্ক ফ্লো দিয়ে সহজেই প্রথাগত নথি চালাচালি না করে ডেস্কে ফাইলের পাহাড় না সাজিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করা সম্ভব। আমরা যারা এই সব টেকনোলজি ব্যবহারে ভীত হবো, তারা এক সময় রেসে থাকতে পারব না। অবস্থা হবে, কোডাক, ফুজি, পোস্ট অফিস, নোকিয়া, সিডিএম এ মোবাইল ফোনের মতো।