নিত্য পণ্যের উচ্চমূল্য এ মুহূর্তে জনগণের সবচেয়ে উদ্বেগ ও অস্বস্তির বিষয়। সরকার দ্রব্যমূল্য কমাতে এলসি মার্জিন শিথিল, খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক হ্রাস ও বাজারে তদারকি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলেও কমছে না নিত্যপণ্যের দাম। ভোক্তারা মনে করেন, ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ইচ্ছামতো বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যাকে বলা হচ্ছে, বাজার সন্ত্রাস এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা দীর্ঘদিন চললেও মূল্যস্ফীতি কমছে না, কার্যকর পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে না। চলতি বছরের শুরুতে ও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেছে। জানুয়ারিতে (২০২৪) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ উঠেছে। গত অক্টোবর (২০২৩) এ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা ছিল সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। নভেম্বর ও ডিসেম্বর (২০২৩) এ মূল্যস্ফীতি একটু কমলে ও জানুয়ারিতে ২০২৪ এ আবার বেড়ে যায়। [সূত্র: বিবিএস]
গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৭ জানুয়ারি ঘোষিত মূল্যস্ফীতিতে নীতি সুদ হার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনের জন্য ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম লক্ষ্যই ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কিন্তু দেখা গেছে নীতি সুদ হারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের সুদ হার বৃদ্ধির পর ও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনীতি বিদদের মতে দেশে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চমূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। বিবি এস তথ্য থেকে দেখা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে (২০২৪) একটু কমলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫৬ শতাংশ ডিসেম্বরে এ ছিল ৯.৫৮ শতাংশে। জানুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়ে যায়। এমনিতে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সমান দিতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ লম্বা সময় ধরে দেখা যাচ্ছে। এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। মূূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমন্নিত উদ্যোগের অভাব আছে। অর্থনীতি বিদদের মতে দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ চাপ সামাল দেয়া সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। এদিকে খাদ্যবহির্ভূত খাতের চেয়ে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। বাংলাদেশের এখন ও ১৮ শতাংশ পরিবার খাদ্যনিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে। যা গত অক্টোবর ২০২৩ এ ছিল ২১ শতাংশ। সম্পতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি। বিবিএস হিসাবে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ডিসেম্বরের তুলনায় নভেম্বরে কমেছে দশমিক ৪ শতাংশ। মূল্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চেয়ে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্যের সরবারাহ, উৎপাদন ও আমদানির তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এদিকে বিবিএস প্রতিবেদনে বলা হয়, গত নভেম্বর-২০২৩ মজুরি বেড়েছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে (২০২৪) বেড়েছে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে কৃষি খাতে বেড়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এই মজুরি বাড়ার চেয়ে খাদ্য পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতায় মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। কর্মহীন হাজারো মানুষ দুদর্শায় জীবন কাটাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের খেটে খাওয়া মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। তারা দৈনিক যে মজুরি পায়, তা দিয়ে দিনের খাদ্য সংগ্রহ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ দিকে আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে মজুতদাররা খাদ্য মজুত বেশি রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মজুতদারদের গণধোলাই দেওয়া উচিত। তিনি আরো বলেছেন, এ মাসে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো সংকট হবে না। কিন্তু বাজারে কিছু কিছু পণ্যের সরবরাহ ভালো থাকলেও দাম কিন্তু কমছে না। এখন নিম্ন আয়ের মানুষের খেজুর কিনা, কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রোজাকে ঘিরে সরকার খেজুর আমদানিতে ১০ শতাংশ মূল্য কমিয়েছে ফলে আমদানি বাড়ায় বাজারে সবধরনের খেজুরের মজুত বেড়েছে; কিন্তু দাম কমেনি। অনেক আমদানি কারক শুষ্ক ফাঁকি দিয়ে উচ্চ মূল্যের খেজুর কম দামে দেখিয়ে আমদানি করেছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি করছে চার থেকে পাঁচগুণ দামে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের খেজুর কি না, যেন বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব এক অনুষ্ঠানে বলেন, পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বাজারে আছে। সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়েছে। ওএমএস কর্মসূচি ও টিসিবির মাধ্যেমে রোজা ও ঈদ ঘিরে দুই কিস্তিতে এবার খাদ্য পণ্য সরবরাহ করা হবে। তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর দু’বার করে ১ কোটি মানুষকে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্থবায়নে মূখ্যসচিবের নির্দেশনা ও ঘোষণা বাস্তবায়নে কতটুকু স্বচ্ছতা ও বাস্তবমুখী হয় তা দেখার বিষয়। প্রকৃত অভাবী, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ এসব কর্মসূচির সুফল পাওয়া দুরুহ। প্রশ্ন হল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী রোধে বাস্তবধর্মী কর্মসূচির এখন ও অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমাদের কৃষি উৎপাদন, কৃষি পণ্যের সরবরাহ চেইন, পণ্য সরবরাহে মধ্যস্বত্বভোগীদের নানান কারসাজী, পণ্যের দাম নির্ধারনে শহর ও গ্রাম-অঞ্চলের মধ্যে সমন্বয় করা। এসব বিষয়ের প্রতিও নজর দেওয়া উচিত। বর্তমানে দেশের জনশক্তির বিরাট অংশ বেকার। আর্ন্তজাতিক সংজ্ঞানুযায়ী দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। তবে শ্রমশক্তির বাইরে আছে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। তারা কর্মে নিয়োজিত নন, আবার বেকার হিসাবেও বিবেচিত হন না। এই শ্রেণির জনশক্তি ধরা হয় শ্রমশক্তির বাইরে। এই দুই অংশমিলে এ সংখ্যা হল ৪ কোটি ৯৭ লাখ ১০ হাজার [বিবিএস তথ্য]।
বিশেষজ্ঞদের মতে যেহারে কাজের বাইরে থাকা জনসংখ্যা বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। এসব লোকদের খাদ্য চাহিদা, পুষ্টিপূরণের জন্য যে পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ ও খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজন তাতে ব্যাপক বেকার জনশক্তির অংশগ্রহণ না থাকা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের শূন্যতা। বেকার জনশক্তি উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করলেও তাদের নিত্যপণ্যের প্রয়োজনীয়তা থাকছেই। অথচ তাদের শ্রম, মেধাগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসূচির গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে, বেকারত্ব বাড়লে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতির স্বার্থে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। শ্রমিক ও পেশাজীবীদের জীবিকা রক্ষার মাধ্যমে, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষের জীবন যাত্রার সহিত জড়িত একান্ত পণ্যসামগ্রী বেশি বেশি উৎপাদন করে, উৎপাদনে সহযোগিতা প্রদান করে, বাজার ব্যবস্থা সহজ করার মাধ্যমে মজুতদারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী। অথনীতিতে ক্রমাগতভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাবে নিম্নবিত্তসহ সকলেই দিনাতিপাত করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইএমএফ-এর ঋণের শর্তানুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথমে মুদ্রানীতিতে সুদ হারের করিডোর প্রথা চালু, সুদ হারের সীমা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি রোধে মুদ্রা সরবরাহনির্ভর নীতি থেকে সরে সুদ হার লক্ষ্য করে মুদ্রনীতি ঘোষণা করে। মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদ হার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদ হার ও বাড়িয়েছে। এতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে নানা সংকট ও জটিলতা কমাতে এর মধ্যেই নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি রমজানকে সামনে রেখে আরো একটি নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে সময় মতো আমদানির অভাবে পণ্যসমূহের বাজার যাতে অস্থিতিশীল না হয়ে ওঠে। বিশ্লেষকরা মনে করেন আমদানি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশে এখনও ডলারের তীব্র সংকট বিদ্যমান। রির্জাভ ক্ষয় অব্যাহত আছে। ব্যাংকগুলোতে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না বাড়তি দামেও। অতি জরুরি পণ্য চাহিদা মাফিক আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে আমদানি কমে গেছে। প্রভাব পড়ছে বাজারে পণ্যের মজুদদারদের উপর। বিদ্যমান পরিস্থিতি সামনে নিয়ে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রমজান মাসে পণ্যের দাম, সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কড়া নজর দারি প্রয়োজন।