সংকট ও সামাজিকীকরণের দায়

সাঈদ চৌধুরী

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বেশিদিন আগের কথা নয়, আমাদের কাছে ঋতুবৈচিত্র্য ছিল স্বাদ পরিবর্তনের উপলক্ষ্যের মতো। যেমন শীতের দিন ছিল সবজিনির্ভর আর গ্রীষ্ম ছিল ফলনির্ভর। এর সাথে ছয় ঋতু বৈচিত্র্যও ছিল চোখে পড়ার মতো। মানুষ এই আনন্দগুলো উপভোগ করত। তখন মানুষের অভিযোগ করত কম উপভোগ করত বেশি। অভিযোগও মানুষ উপভোগ করেছে একটা সময়। গ্রাম্য সালিশ থেকে আমরা উন্নত বিচারিক ব্যবস্থার জন্য আইনকে কতভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সভ্যতার মাপকাঠিকে নতুনভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছি। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধারার বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের ফলে মানুষের খাদ্য ও ঋতু ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে অনেক। ধরুন আজ গরমের সময় যাচ্ছে। আপনার শীতের সবজি ফুলকপি খেতে মন চাইল। আপনি কিন্তু ঘরে এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শীতের আমেজে ফুলকপির তরকারি খেতে পারবেন। আবার শীতের সময়ে গ্রীষ্মের ফল আম খেতে মন চাইল। দেশে বাইরে থেকে আসা অথবা দেশের ভেতরে বারমাসি কাটিমন জাতের আম আপনি শীতের দিনেই ঘরে বসে খেতে পারছেন। উৎপাদনের প্রক্রিয়া ভিন্নতার কারণে সবকিছু হাতের মুঠোয় আনার পর আমরা তবে কী হারালাম? এ প্রশ্নটি কেউ করতে পারছে না, এই চিন্তাটি সবার প্রথমে হারিয়েছি। সবাই ভাবছে সব আছে; কিন্তু কী কী যেন নেই! এই কী কী এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ব্যপারটি হারিয়েছি, তা হল আমাদের মানবিক আচরণের উদারতা। তার প্রমাণ সমাজের সব জায়গায় পাবেন। শুধু গাজীপুরের শ্রীপুরের গত বৃহস্পতিবারের তিনটি সংবাদ বিবেচনা করে দেখতে পারেন। ১. এনজিওর মাসিক কিস্তি দিতে না পারায় বসত ঘরে তালা ঝুলালো এনজিও কর্মীরা, ২. কিশোর গ্যাংয়ের ছুড়িকাঘাতে এসএসসি পরীক্ষার্থী আহত! এবং ৩. কলা খেতে একজন গৃহবধূর পোড়া লাশ পাওয়া যাওয়া! প্রথম সংবাদের কথা বিবেচনা করুন। কিস্তি না দিতে পারায় পরিবারকে তার নিজের ঘরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ঘর তালা দিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। প্রতিষ্ঠান কখন জনসাধারণের অধিকারের উপরে উঠে যেতে পারে? আদৌ কি নাগরিকের চেয়েও বেশী শক্তিধর কোনো প্রতিষ্ঠান? আম্বালা ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি দিতে না পারার কারণে যা হয়েছে, তা একটি চোখের সামনে আসা চিত্র মাত্র। এর চেয়েও অনেক করুণ বিষয় ঘটেছে কিস্তির দায় মেটাতে। মানুষের অসহায়ত্ব আসতে পারে না। মানুষ কোনো কারণে এমন হতে পারে না যে সে কিস্তি দিতে অপারগ হয়ে গেছে? ব্যাংকিং নীতিমালা কীভাবে করলে জনবান্ধব হয় আচরণ তা নিয়ে আমরা না ভেবে কেন এমন করুণ দৃশ্যের স্বাক্ষী হই! এই সংবাদটি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আইনগত কাঠামো পরিবর্তন করে দিতে পারবে? কেউ আম্বালা ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্র দেখে প্রশ্ন তুলতে পারবে, এমন করে যে গঠনতন্ত্রে ঋণদান কর্মসূচি উল্লেখ করা আছে কি না? মানুষের অভাব বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে টাকাকে সহজে প্রাপ্তির একটি প্রক্রিয়া বের করে ফেলতে। যে প্রক্রিয়ায় আবার বিনিময় প্রথার একটি সিস্টেম চালু হবে। তাহলে বোধ হয় সিন্ডিকেটও কমে যেতে পারে! যাই হোক অর্থনীতির পুরো সাইকেল হয়তো বদলে দেওয়া যাবে না, তবে নিয়মের মধ্যে এনে জনসাধারণের অধিকারকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের জায়গায় স্থাপন করা যাবে। তা না হলে মানুষের এমন অসহায়ত্ব পুরো রাষ্ট্রকে এক সময় গ্রাস করবে। সামাজিকীকরণ সবসময় কিছু চেইন মেইনটেন করে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিষয় হলো অর্থের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও তার বিপরীতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে ফেলা। বলুন তো কিশোর অপরাধ কেন বাড়ছে? অনেকগুলো কারণের মধ্যে দেখবেন অর্থের ছড়াছড়ি একটি বড় কারণ। দুদিন আগে খুব সামান্য কারণে এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুড়িকাঘাত করেছে তথাকথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। বলা হচ্ছে ছেলেটি ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করতে যেয়ে এমন হামলার শিকার হয়েছে। দেখুন কতটা রুঢ় চিন্তার মানসিকতা অর্জন করছে আমাদের এ প্রজন্মের শিশুরা। বিচার চাইতে গেলেও ভয়ে থাকতে হচ্ছে সাধারণে মানুষদের। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এদের দিলে যে সমাজ খারাপ হয়। সে ব্যাপারে স্বয়ং রাজনীতিকদেরও অনেক দ্বিধা আছে। তার কর্মী বলে সব ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা কিশোর গ্যাং বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কথা বোঝানোও কি খুব সহজ? কিশোর গ্যাং বন্ধ করার ব্যাপারে এখন আর পারিবারিক শিক্ষার বিষয়টিতে বাঁধা নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে পুলিশিং ব্যবস্থাপনাকে। একটি এলাকার যত কিশোর আছে সবাইকে নিয়ে বসতে হবে পুলিশের। তারা কীভাবে এমন অপরাধী হয়ে উঠছে, সে ব্যপারে তাদের সাথে না বসলে এবং জিরো টলারেন্সে না গেলে, এটাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এক সময়! সাথে সাথে পারিবারিককলহ এখন চিন্তার বড় বিষয়। অভাবের তাড়নার চেয়ে অভাব বোধটা মানুষের বেশি হচ্ছে ইদানিং। অন্যেরটা দেখে নিজেদের অপ্রাপ্তিগুলোকে চিন্তা করা! অভাবের বোধের ভ্যপ্তি বাড়ার ফলে পারিবারিক কলহ এখন প্রধান সমস্যা!

গাজীপুরের শ্রীপুরে কলার বাগানে একজন নারীর পোড়া লাশ পাওয়া যায় গত বৃহস্পতিবার। ধারণা করছেন অনেকে নারীর স্বামী এই ধরনের কাজটি করেছেন। কারণ নারীর বাবার ভাষ্যমতে প্রায়ই নির্যাতন করত তার স্বামী। আর তারই ধারাবাহিকতায় এমন হত্যা! যাই হোক সবই সামাজিক অস্থিরতার মধ্যেই যাচ্ছে। একটা স্তরে এমন ভেঙে যাওয়া মূল্যবোধের প্যারামিটার কি দিয়ে সারাব আমরা? ঋতুবৈচিত্র্যের এ দেশ কবে এমন অপরাধ বৈচিত্র্যের দেশে পরিণত হলো, এটা সত্যিই বড় প্রশ্ন। এখন খাবারের পর্যাপ্ততা বেড়েছে, অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে; কিন্তু পরিতাপ হলো অপরাধ বাড়ছে। কিছু একটা কাজ করতে হবে। মানুষের মনকে ভালো কথা পড়াতে হবে। জীবনকে টেনে ধরার শেখাতে হবে। বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের ভেতরের শিক্ষার চেয়েও এখন সামাজিক শিক্ষক বেশি দরকার। সামাজিক শিক্ষক বেশি পেতে হলে সৎ মানুষ তৈরি করতে হবে। আদর্শ মানুষকে সামনে নিয়ে বলতে হবে সন্তানকে তুমি এই মানুষটির মতো হও। সামাজিক শিক্ষক ছাড়া এখন আর পরিবর্তনের উপায় নেই। যেখানে সব সম্ভব হচ্ছে নীতির বাইরে গিয়ে সেখানে নীতির মধ্যে আনা শুধু চ্যালেঞ্জই না বরং সংগ্রামের। সময় এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ কীভাবে আনে, এটিই এখন দেখার বিষয়!

লেখক : কলাম লেখক ও রসায়নবিদ।